Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার |
বায়ু দূষণের দিক থেকে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। প্রাণের নগরী ঢাকা ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। এই বায়ু দূষণ কিংবা পরিবেশে দূষণের জন্য দায়ী কলকারখানার দূষিত বায়ু এবং বর্জ্য পদার্থ। প্রায়ই খবরের কাগজে আমরা কারখানায় অগ্নি সংযোগের কথা, কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার কথা শুনতে পাই।
এইদিক থেকে ব্যতিক্রধর্মী এক কারখানার নাম কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড। তীব্র তাপদাহে দেশের মানুষের জীবন যখন অতিষ্ঠ, তখন ব্যতিক্রমী এই কারখানার ভেতরের তাপমাত্রা মাত্র ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস! প্রায় আট লাখ বর্গফুটের বিশাল এই কারখানায় রয়েছে সাততলা ভবন। প্রতিটি ফ্লোর ৪০ হাজার বর্গফুটের। দিনে-রাতে দুই শিফটে এখানে কাজ করেন প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। এত বড় কারখানার একটি কক্ষে এসি রয়েছে। নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জেগেছে- তাহলে এই কারখানার ভেতরের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি কিভাবে? এর উত্তর হলো কারখানার বিশেষ ধরনের স্থাপত্যকৌশল। চলুন জেনে নেই কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের আদ্যোপান্ত।
কারুপণ্যের যাত্রা
কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা শফিকুল আলম সেলিম। তাঁর জন্ম রংপুরের গুপ্তপাড়ায়। হস্তশিল্পের সাথে তাঁর জীবন জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বেশ অদ্ভুত। রাজনৈতিক কারণে তিনি তিনমাস রংপুর জেলে ছিলেন। সেসময় তিনি হস্তশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। তারপর তিনি রংপুর প্রেসক্লাবের বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার বন্ধ থাকা হস্তশিল্পের একটি দোকান ভাড়া নেন। সেখানে চালু করেন একখানা শতরঞ্জি বিপণন কেন্দ্র। হারিয়ে যাওয়া এই শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা ২০ জন কারিগরকে তিনি খুঁজে বের করে প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন কারিগর তৈরি করেন। ১৯৯১ সালে তিনি গড়ে তোলেন কারুপণ্য নামে রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি বিপণনের দোকানটি। শতরঞ্জির প্রতি বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে নানান দেশে প্রচারণা চালাতে থাকেন।
সর্বপ্রথম ২০০২ সালে জাপানে এই পণ্য রপ্তানির সুযোগ পান। ব্যবসার প্রসার করার জন্য রংপুর শহর থেকে চার কিলোমিটার পশ্চিমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি কারখানা ভাড়া নিয়েই শুরু করেন নিজ কারখানা। ৫০ জন নারী—পুরুষকে নিয়ে তিনি শতরঞ্জি বুনন শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম দেন কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড। শতরঞ্জি দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন কারুপণ্যের কারখানায় তৈরি হচ্ছে নানা রকমের হস্তশিল্প পণ্য। বর্তমানে দেশের হস্তশিল্প রপ্তানি বাণিজ্যে শিল্পখাতে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে কারুপণ্য। সেজন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদক পেয়ে আসছে।
সবুজের রাজ্য
এই কারখানায় কেউ প্রবেশ করলে মনে হবে কোনো সবুজের রাজ্যে চলে এসেছে। গাছগাছালিতে ভরা নান্দনিক এই সবুজ কারখানায় প্রতিনিয়ত ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। এই গ্রিন ফ্যাক্টরির জন্য বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ স্থাপত্য পুরস্কার রিবা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স-২০২৪ পেয়েছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘নকশাবিদ আর্কিটেক্টস। গ্রামবাংলার লোকজ জ্ঞান প্রয়োগে গড়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন এই সবুজ কারখানাটির স্থপতি নকশাবিদ আর্কিটেক্টসের প্রধান বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার। এ কারখানা যেন সবুজের রাজত্ব। চারদিকে কেবল সবুজের সমারোহ। ইট—পাথরের দালান ছেয়ে আছে নানা প্রজাতির গাছপালা আর ফুল—ফলে। দালান বেয়ে ঝুলছে লতাপাতা। সেবা বিভাগের একতলা ভবনের ছাদেও রয়েছে সবুজের বাগান। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘নন্দিনী পার্ক’। এখানে রয়েছে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কারুকার্যখচিত বেঞ্চ। এই নন্দিনী পার্কে বসে দুপুরের খাবার খান শ্রমিকরা।
বনলতা ভাস্কর্য এবং জলাধার
পুরো কারখানা চত্বর জুড়ে প্রায় হাজার হাজার ছোট-বড় ভাস্কর্য রয়েছে। ক্ষুদ্রাকৃতির মহিলা ভাস্কর্যগুলি সিঁড়ি এবং অভ্যন্তরীণ দেয়ালগুলিকে সজ্জিত করেছে। কম্পাউন্ডে প্রবেশ করার সময় সাইটের সামনের অংশের উঠোনে টেপাপুতুল আকৃতির “বনলতা” নামে একটি চমৎকার ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্যটি মূলত নারীর ক্ষমতায়নের শক্তির প্রতীক। কারণ, এই কারখানার ৫০০০ কর্মচারীর আশি শতাংশই নারী। আর তাই নারীর এই ক্ষমতায়নকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তৈরি করা হয়েছে বনলতা ভাস্কর্য।
কারখানার পরিবেশ সবসময় শীতল রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে জলাধার। নিচতলায় লবিতে পুকুরের মতো বড় বড় চারটি জলাধার রয়েছে। ১৫ হাজার বর্গফুট ব্যাসার্ধের এ জলাধারগুলো একসঙ্গে ধারণ করতে পারে ৫ লাখ লিটার পানি। আয়রনমুক্ত এই পানি কারখানায় শতরঞ্জি ডাইংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়ে এই জলাধারে আসে। সবুজ গাছপালা আর এই পানির ওপর দিয়ে উড়ে আসা বাতাস ৩৭ ফুট ব্যাসার্ধের চারটি চক্রাকার শূন্য স্তম্ভের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কারখানার ভেতরে। তারপর বিভিন্ন তলায় উঠে যায়। ফলে এসি বা ফ্যান ছাড়াই কারখানার বাইরের চেয়ে ভেতরের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়।
কারুপণ্যের বিশেষত্ব
কারুপণ্য কারখানাটি অন্য যেকোনো কারখানা থেকে বেশ আলাদা ধরনের। চারদিকে সবুজের সমরোহ এই কারখানাকে করে তুলেছে সবার থেকে আলাদা। অন্য কারখানার মতো কারুপণ্যের এই কারখানায় কালো ধোয়া, নোংরা দুর্গন্ধময় পানি কিংবা রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ নির্গমন হয় না। এই কারখানায় ব্যবহার করা হয় প্রাকৃতিক ও নবায়নকৃত কাঁচামাল। যেমন- স্পিনিং মিলের তুলার বর্জ্য থেকে তৈরি সুতা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ঝুট কাপড়, পাটের অঁশ, কাশ-খড়, হোগলাপাতা, ধানের খড়, কচুরিপানা, কলাগাছের বাকল, ভুট্টার খোসা, নারকেলের ছোবড়া ইত্যাদি। কারখানার চারদিকে সবুজের সমরোহের পাশাপাশি কর্মীদের জন্য রয়েছে নানা সুবিধা। দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা, চিকিৎসা সুবিধা, কর্মীদের শিশুদের দেখাশোনার জন্য ডে কেয়ার, ইমার্জেন্সি আগুন নেভানোর ব্যবস্থা, নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার থেকে শুরু করে আরো নানা ধরনের সুবিধা।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত
পরিবেশ সংগঠকরা এই গ্রিন ফ্যাক্টরি নিয়ে বেশ আশাবাদী। তারা মনে করেন এই কারখানা দেখে আরো অনেকে উদ্বুদ্ধ হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) রংপুর জেলা সদস্য সচিব রশিদুস সুলতান বাবলু এর মতে, ‘দুষণমুক্ত পরিবেশ ও তাপমাত্রা ভারসাম্য রক্ষায় কারুপণ্যের কারখানাটি একটি অনন্য স্থাপনা। এই কারখানাটির সবুজায়ন বাইরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে যেমন নির্মল রাখছে তেমনি বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নির্গমনও করছে’।
প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে কারখানায় অগ্নি সংযোগের ঘটনা, শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার কথা, বায়ু দূষণে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে যাওয়া কিংবা তীব্র তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হওয়া এতো এতো খারাপ সংবাদের মাঝে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। এই গ্রিন ফ্যাক্টরি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সবুজের সমরোহ ছড়িয়ে যাবে রংপুর থেকে ঢাকা সারাদেশে, এই প্রত্যাশা এখন সকলের।
Comments