Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার |
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে, ক্লাসের শেষে কিংবা কাজের ফাঁকে, বন্ধুদের আড্ডা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সারাদিনে কম-বেশি আমরা সকলেই ফেসবুক ব্যবহার করে থাকি। ফেসবুক এখন কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফেসবুক আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ৩.০৭ বিলিয়ন মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। সারা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমরা সকলেই মার্ক জুকারবার্গকে চিনি। চলুন জেনে নেওয়া যাক মার্ক জুকারবার্গের শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে, কিভাবে তিনি ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করেছেন আর কিভাবে ফেসবুক সারা বিশ্বে এতো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
শুরুর দিনগুলো
মার্ক জুকারবার্গ ১৯৮৪ সালের ১৪ মে নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা এডওয়ার্ড জুকারবার্গ, পেশায় একজন ডেন্টিস্ট এবং মা কারেন জুকারবার্গ পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। চার ভাইবোনের মধ্যে মার্ক দ্বিতীয়। জুকারবার্গ তাঁর বাবার হাত ধরে কম্পিউটার চালানো এবং প্রোগ্রামিং করা শিখেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে মার্ক তাঁর বাবার কাছে আটারি বেসিক শিখেছিলেন। শুধু তাই নয়, সফ্টওয়্যার ডেভেলপার ডেভিড নিউম্যান মার্কের ব্যক্তিগত শিক্ষক ছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে, মার্ক তাঁর পরিবারের জন্য ‘জাকনেট’ নামের একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। এছাড়াও এসময় তিনি কয়েকটি কম্পিউটার গেইম তৈরী করেছিলেন।
ফেসবুকের সূচনা
মার্ক জুকারবার্গ হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স এবং সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।২০০৩ সালে হার্ভার্ডের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন তিনি ‘ফেসম্যাশ’ নামের একটি ওয়েবসাইট তৈরী করেছিলেন। হার্ভার্ডের নেটওয়ার্ক হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের আইডিকার্ডের ছবি ব্যবহার করে নতুন এই ওয়েবসাইট তৈরি করেছিলেন৷ ওয়েবসাইটের ভিজিটররা এই সাইট ব্যবহার করে দুটি শিক্ষার্থীর ছবি পাশাপাশি তুলনা করতে পারে এবং কে “হট” এবং কে “নয়” তা নির্ধারণ করতে পারে। এই ওয়েবসাইটের জন্য জুকারবার্গ নিরাপত্তা লঙ্ঘন, কপিরাইট লঙ্ঘন এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের সম্মুখীন হন।
৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৪ সালে জুকারবার্গ ‘দ্যা ফেসবুক’ নামে একটি নতুন ওয়েবসাইট চালু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একে অপরকে আরও ভালভাবে জানতে সাহায্য করার জন্য যে ডিরেক্টরিগুলি হস্তান্তর করা হয়েছিল সেগুলির নামানুসারে তিনি সাইটটির নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু ছয় দিন পরে তাঁর হার্ভার্ড সিনিয়র ক্যামেরন উইঙ্কলেভস, টাইলার উইঙ্কলেভোস এবং দিব্যা নরেন্দ্র অভিযোগ করেন যে, মার্ক তাদের ওয়েবসাইট ‘হার্ভার্ড কানেকশন’ এর ধারণা চুরি করে নতুন এই ওয়েবসাইট চালু করেন। শুরুতে ‘দ্যা ফেসবুক’ ওয়েবসাইট শুধু হার্ভার্ড শিক্ষার্থীদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের সাথে সাথে, জাকারবার্গ ওয়েবসাইটটিকে বড় করতে সাহায্য করার জন্য তার কয়েকজন সহকর্মীকে সাথে নেন। তারা হলেন এডুয়ার্ডো সাভারিন ,ডাস্টিন মস্কোভিটজ, অ্যান্ড্রু ম্যাককলাম এবং ক্রিস হাগস।
ফেসবুকের সাফল্য
ফেসবুক অনেক কম সময়ে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০০৬ সালে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ১২ মিলিয়ন। ২০০৭ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ৫০ মিলিয়ন হয়। একবছর পর এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ১০০ মিলিয়ন হয়।
২০১২ সালে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ফেসবুকের এই সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো ব্যবহারকারীদের জন্য নিত্যনতুন কিছু নিয়ে আসা। মেসেজিং, অডিও-ভিডিও কল থেকে শুরু করে স্টোরিতে গান দিতে পারা, নোট শেয়ার করা, ইমোজি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা সহ নিত্যনতুন আপডেট ফেসবুক করতে থাকে।
‘মেটা’ যুগের সূচনা
২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর মার্ক জুকারবার্গ মেটা প্ল্যাটফর্মের ঘোষণা দেন। বর্তমানে মেটার অধীনে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ এবং থ্রেডস সহ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো রয়েছে। প্রতিমাসে তিন বিলিয়ন মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে।
বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অর্ধেকেরও বেশিসংখ্যক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে যা বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার চ্যালেঞ্জ
ফেসবুক গত ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে তা হলো ব্যবহারকারীদের তথ্যের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা সংক্রান্ত সমস্যা। ২০১৮ সালে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে । সেসময় প্রকাশ পেয়েছিলো যে, ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা ২০১৪ সালের শুরুর দিকে ৮৭ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোটারদের প্রোফাইল তৈরি করে, তাদের জন্য ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের তৈরি করতো। জুকারবার্গ ক্যাপিটল হিল, ওয়াশিংটন ডিসিতে তার প্রথম কংগ্রেসের শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন। যেখানে তাকে ব্যবহারকারীদের তথ্যের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জুকারবার্গ সেখানে জরিমানা দিতে সম্মত হন এবং তিনি বলেছিলেন যে তিনি প্ল্যাটফর্মে গোপনীয়তার প্রবিধান বাড়াবে।
জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আধুনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। ফেসবুক শুধু ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রেই নয় বরং ব্যবসা, রাজনীতি এবং সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ব্যবহারকারী বৃদ্ধির সাথে সাথে তথ্যের গোপনীয়তা এবং তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতের মতো বিষয়গুলো নিয়েও সৃষ্টি হচ্ছে শঙ্কা। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য জুকারবার্গের পদক্ষেপের উপর নির্ভর করছে ফেসবুকের ভবিষ্যৎ।
Comments