কোম্পানি ফরেনসিকস

যেভাবে পতন হলো বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠান বাইজুসের

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আনিকা তায়্যিবা

যদি বলা হয় মোবাইলের মাধ্যমে অঙ্ক শেখার কথা, শুরুতেই আপনার মাথায় কিসের নাম আসে? 

ইউটিউব ভিডিও? 

না।

অঙ্ক কেবল দেখে নয়, শিখতে হয় অনুশীলনের মাধ্যমে। বর্তমানে তাই  দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে টেন মিনিটস স্কুল বা শিখো- এর মতো মোবাইল অ্যাপস। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথা যদি বলি, তাহলে যেই অ্যাপের কথা বলতে হয় তা হলো বাইজুস। একসময় ভারতের শিক্ষাপ্রযুক্তি (এডটেক) খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল এই কোম্পানি।  তবে বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্যে আছে এই এডটেক প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালে বাইজু রবীন্দ্রন এবং দিব্যা গোকুলনাথের প্রতিষ্ঠা করা এই প্রতিষ্ঠান ভারতে শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুনত্ব এনেছিল এবং শিক্ষার্থীদের জন্য পড়ালেখার এক প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান প্রদান করেছিল।

২০১৫ সালেবাইজুস: দ্য লার্নিং অ্যাপ’’ চালু হওয়ার পর এটি এত দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে অবিশ্বাস্যজনকভাবে মাত্র তিন মাসে দুই মিলিয়ন ডাউনলোড এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে। তবে কয়েক বছরের মধ্যে একের পর এক কৌশলগত ভুল এবং কারিগরি জটিলতায় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বসের মুখে পড়ে, যে এক সময়কার বিলিয়ন ডলার কোম্পানি আজ দেউলিয়া হওয়ার পথে। আজ আমরা জানতে চলেছি সেই আলোচিত কোম্পানি বাইজুস সম্পর্কে।

শুরুর দিকে সাফল্যের দিনগুলো  

প্রথমদিকে বাইজুস শিক্ষার্থীদের জন্য অঙ্ক শেখার মজার লার্নিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাইজুসের প্রতিষ্ঠাতা বাইজু রবীন্দ্রন বুঝতে পারেন শিক্ষার্থীদের জন্য যদি ইন্টারেক্টিভ কনটেন্ট, গেমস বা ভিজুয়াল কন্টেন্ট তৈরি করা যায় তবেই সফলতা আসবে। কারণ এতে করে বেশী সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করা যাবে। মূলত গেমিফিকেশন এবং ভিডিও লার্নিংয়ের সমন্বয়ই ছিল বাইজুস-এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি অফলাইন ক্লাস এবং শিক্ষামূলক ট্যাবলেট পিসি সরবরাহ করা শুরু করে, যা ইন্টারনেট সংযোগ নেই এমন শিক্ষার্থীদের জন্যেও সহায়ক হিসেবে কাজ করছিল।  

এসকল কৌশলের মাধ্যমে বাইজুসএর প্রচার প্রসার হতে থাকে। প্রোগ্রামিং কোর্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘হোয়াইটহ্যাট জুনিয়র’  এবং বহুপুরোনো ও অভিজ্ঞ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা প্রস্তুতির প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ এডুকেশনাল সার্ভিসেস’ও বাইজুস কিনে নেয়। এর মাধ্যমে তারা শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবেশ করে। ২০১৯ সালে বাইজুস ভারতীয় ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষক হয় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে আইসিসি ফিফা বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক প্লাটফর্মেও বাইজুস প্রতিনিধিত্ব করে। এই উদ্যোগগুলির মাধ্যমে বাইজুস শুধু ভারতেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

২০১৯ সালে বাইজুস ভারতীয় ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষক হওয়ার ছবি।

২০১৯ সালে বাইজুস ভারতের ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষক হয়ে স্পন্সরশিপের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। | ছবি: সংগৃহীত।

অতিরিক্ত সম্প্রসারণ এবং কিছু ভুল সিদ্বান্ত  

২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাইজুস প্রায় ১৯টি কোম্পানি অধিগ্রহণ করে, যার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু এই অধিগ্রহণগুলো সঠিকভাবে সমন্বয় করা বাইজুসের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের কারিগরি ব্যয় বেড়ে যায় এবং বেশ কিছু কার্যক্রমে ধ্বস দেখা দেয়। নতুন কেনা কোম্পানিগুলোতে কর্মীসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ে অভাব দেখা দেয়। এর পাশাপাশি গ্রাহক ধরে রাখার হারও কমে যেতে থাকে। ফলে আয় কমতে শুরু করে, তবে বাইজুস এই ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বজায় না রেখে ব্যয় বাড়িয়ে চলে। ফলে বিরাট অর্থসংকট দেখা দেয়।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং ঋণ সংকট

বাইজুস তার প্রবৃদ্ধি টিকিয়ে রাখতে প্রচুর ঋণ নেয়া শুরু করে, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির উপর চাপ বাড়ে। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়। এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এর ফলে বাইজুস বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বেশ কয়েকটি আইনি বিরোধেও জড়িয়ে পড়ে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হওয়ায় নতুনভাবে ঋণ বা আর্থিক তহবিল সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।  প্রতিষ্ঠানটি কয়েক দফায় কর্মী ছাঁটাই করে পরিচালন ব্যয়  নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায় যদিও সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

বিপণন কৌশল নিয়ে নীতিগত জটিলতা 

বাইজুসের বিপণন কৌশল নিয়ে বেশ সমালোচনা শুরু হয়, বিশেষত তাদের আক্রমণাত্মক বিক্রয় কৌশল নিয়ে। কর্মীদেরকে প্রত্যেক সপ্তাহে এক লক্ষ গ্রাহকের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হতো, যা পূরণে ব্যর্থ হলে কর্মী ছাটাই এর সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। ফলে যেকোনো মূল্যেই হোক কর্মীরা তাঁদের টার্গেট পূরণে কাজ করতেন। জানা গেছে এক কর্মী নিজেই ১৫,০০০ টাকা খরচ করে বাইজুসের কোর্স কিনে নিজের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছিলেন। এমনকি শিক্ষার্থীদের অভিভাবক দ্বারা জোর করে কোর্স কেনানোর মতো ঘটনাও ঘটে।

এছাড়াও, ভারতের বাজারে নতুন এডটেক কোম্পানির আবির্ভাব ঘটে।ফলে এই সাশ্রয়ী মূল্যের শিক্ষা সমাধানগুলো প্রতিযোগিতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বাইজুসের পণ্যের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ কমতে শুরু করে, এবং বাইজুসের পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সরকারি নীতিমালা নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপ প্রতিষ্ঠানটির বিপণন পরিচালন কৌশলে বাধা সৃষ্টি করে।

এরই মাঝে বাইজুসের সিইও অর্জুন মোহন পদত্যাগ করেন। এতে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্থায়ী সংকট তৈরি হয়। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালন কমিটি পুনর্গঠন কর্মীদের মনোবল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বাইজুস  ব্যর্থ হয়।

বিপণন কৌশল নিয়ে নীতিগত জটিলতার চিত্র।

বাইজুস এবং বিপণন কৌশল নিয়ে নীতিগত জটিলতা – ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে নৈতিকতার ভূমিকা। | ছবি: সংগৃহীত।

পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা এবং বাইজুসের ভবিষ্যৎ 

যদিও বাইজুস এখন আর্থিক নীতিগত জটিলতায় জর্জরিত একটি প্রতিষ্ঠান , তবে এটি তাদের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাইজুসের অভিজ্ঞতা থেকে অন্য স্টার্টআপ বা ব্যবসাগুলো শিখতে পারে যে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয় এবং সঠিক পরিচালন কৌশল বজায় রাখা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বাইজুসের উত্থানপতনের গল্প শুধুমাত্র একটি এডটেক কোম্পানির গল্প নয়, বরং এটি স্টার্টআপ দুনিয়ায় টেকসই পরিচালনার কৌশলগত ভুলগুলো শেখাতে ও তা সংশোধন করতে সাহায্য করে।

“তথ্যসূত্র”

বিমানের ইঞ্জিন থেকে লাক্সারি গাড়ি নির্মাতা বিএমডাব্লিউ

Previous article

গ্রামীনফোন কোটি বাঙালির হৃদয় জিতেছে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটি দিয়ে

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *