Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার |
কর্মব্যস্ততায় ভরপুর দৈনন্দিন জীবনে আমরা সকলেই কম-বেশি অনলাইন শপিংয়ের উপর নির্ভরশীল। আর অনলাইন শপিংয়ের কথা শুনলেই যে প্ল্যাটফর্মের নাম আমাদের সবার আগে মাথায় আসে তা হলো দারাজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ১১.১১ সহ দারাজের নানা ক্যাম্পেইনের কথা আমরা শুনে থাকি। আচ্ছা, কখনো কি আমরা ভেবেছি দারাজ কিভাবে যাত্রা শুরু করেছে? দারাজের ইতিহাস সম্পর্কে কি আমরা জানি? চলুন আজকে আমরা বিস্তারিত জেনে নেই কিভাবে দারাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংলাদেশে এর যাত্রা শুরু করে কিভাবে শীর্ষ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।
শুরুর যাত্রা
জনপ্রিয় ই-কর্মাস প্ল্যাটফর্ম দারাজের যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালের দিকে। উর্দুতে দারাজ শব্দের অর্থ ‘ড্রয়ার’। মূলত জনপ্রিয় জার্মান স্টার্টআপ রকেট ইন্টারনেটের কর্মকর্তা মুবীন ময়ুর (প্রধান প্রতিষ্ঠাতা) এবং ফরিস শাহয়ের (সহ-প্রতিষ্ঠাতা) হাত ধরে দারাজ যাত্রা শুরু করে। তারা দুইজন মূলত ফ্যাশন জাতীয় প্রোডাক্ট খুচরা বিক্রি করার লক্ষ্যে দারাজ প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রাহকদের অনলাইনে কেনাকাটা করার একটি সহজ এবং সুবিধাজনক উপায় প্রদানের লক্ষ্যে কোম্পানিটি প্রথম পাকিস্তানে চালু করা হয়েছিল। দারাজের প্রাথমিক অর্থায়ন করেছিলো রকেট ইন্টারনেট। ইউরোপীয় এই প্রতিষ্ঠান মূলত দক্ষিন এশিয়ায় ই-কর্মাস চালু করার লক্ষ্যে দারাজে বিনিয়োগ করে।
দারাজ পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে কোম্পানিটি বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার এবং শ্রীলংকাতে নিজেদের কার্যক্রম বিস্তৃত করে। শুরুতে এটি শুধু অনলাইন ফ্যাশন রিটেইলিং ওয়েবসাইট হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি একটি সাধারণ অনলাইন মার্কেটপ্লেসে পরিণত হয়।
দারাজ বাংলাদেশের যাত্রা
বাংলাদেশে ২০১৫ সালে “দারাজ বাংলাদেশ” নামে দারাজের কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যক্রম শুরুর পর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের তৎকালীন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম দারাজের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেন। দারাজ ২০১৫ সালে গ্রাহকের সেবা বৃদ্ধিতে অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোন ব্যাবহারকারীদের জন্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালু করে। এরপর থেকেই দারাজ খুব দ্রুত বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমানে দারাজ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠান। দারাজের কার্যক্রম ৫ টি দেশে বিস্তৃত থাকলেও, দারাজ বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ প্রফিট অর্জন করে। দারাজের তথ্য অনুসারে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ দারাজ বাংলাদেশের ওয়েবসাইট ভিজিট করেন। শুধু তাই নয়, দারাজ প্রতি মাসে সরকারী কোষাগারে প্রায় ৫ কোটি টাকা কর দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ করদাতা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
দারাজের এবং আলিবাবা – নতুন যুগের সূচনা
ই-কর্মাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান কিংবা জায়ান্ট হলো আলিবাবা। ২০১৮ সালের ৯মে আলিবাবা দারাজ গ্রুপকে কিনে নেয়। আর এর মধ্য দিয়েই সূচনা হয় দারাজের নতুন যুগের। আলিবাবা যখন দারাজকে কিনে নেয়, তারপরই দারাজ আরো বেশি বিস্তৃত লাভ করতে থাকে। আলিবাবা দারাজকে ই-কর্মাস প্ল্যাটফর্মের গ্লোবাল নেটওয়ার্কের অংশ করে তুলে। বর্তমানে দারাজ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, মায়ানমার, শ্রীলংকা ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, হংকং সহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে লাজাডা নামে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
দারাজের সাথে আলিবাবার এই নতুন সূচনার গল্পটি বেশ চমকপ্রদ। দারাজের তৎকালীন সিইও বার্জাক মিক্কেলসেন আলিবাবার প্রেসিডেন্ট জন মাইকেলের পূর্বপরিচিত হওয়ায় তার সাথে যোগাযোগ করেন। বার্জাক ভেবেছিলেন আলিবাবা দারাজে ছোট বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্ত হবে। কিন্তু আলিবাবা তাদের কোম্পানি ফরেন্সিকে মুগ্ধ হয়ে পুরো কোম্পানিটি কিনে নেয়। আর এভাবেই আলিবাবার সাথে দারাজের যাত্রার শুরু।
দারাজ কেনো বাংলাদেশে এত জনপ্রিয়?
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ লিডিং ই-কমার্স কোম্পানি হলো দারাজ। সাধারণত বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিভিন্ন দেশ থেকে পন্য কেনা বেশ ঝামেলার হয়ে থাকে। কিন্তু দারাজ বিদেশি সেলারদের প্রোডাক্ট সরসারি বাংলাদেশে ডেলিভারি করারও ব্যাবস্থা করে দিচ্ছে । এছাড়াও দারাজে রয়েছে ৭ দিনের ইজি রিটার্ন পলিসি এবং দেশীয় পণ্য সর্বোচ্চ ৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির সুযোগ। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি দারাজ এক্সপ্রেস নামের একটি প্রিমিয়াম ডেলিভারি পরিষেবা চালু করেছে। যার মাধ্যমে দারাজের পণ্যগুলো ঢাকার ভিতরে মাত্র ২৪ ঘন্টা এবং ঢাকার বাইরে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি করা যায়। এছাড়াও, দারাজ নিত্য নতুন সব ক্যাম্পিং বিভিন্ন স্পন্সরশীপে কাজ করে আসছে। ফলে দারাজ কম সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এরমধ্যে তাদের ১১.১১ ক্যাম্পেইন বেশ জনপ্রিয়। ২০২২ সালে এই ক্যাম্পেইনে প্রোডাক্ট কিনেছিলো ৬০ লক্ষেরও বেশি মানুষ।
চ্যালেঞ্জ এবং দারাজের পদক্ষেপ
দারাজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভোক্তাদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করা। এ বিষয়ে দারাজের তৎকালীন সিইও বার্জাক মিক্কেলসেন বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ই-কমার্স কেলেঙ্কারিগুলোকে বেশ অস্বাভাবিক মনে করেন। দারাজের বিপক্ষেও বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। দারাজ চেষ্টা করছে যাতে তারা ভোক্তাদের সর্বোচ্চ পরিষেবা প্রদান করতে পারে। তবে বার্জাক ভবিষ্যতে যাতে বাংলাদেশের ই-কর্মাস খাতে এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে, তার জন্য বেসরকারি খাত এবং সরকারের মধ্যে সহযোগিতা কামনা করেছেন।
এই সকল সমস্যা সমাধানে দারাজে দুইটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমত, তারা তাদের পণ্যের মানের উপর মনোযোগ দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তারা বিক্রেতার কার্যক্রমের উপর মনোযোগ দিচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশী ব্যবহারকারীরা যাতে বাংলায় দারাজ অ্যাপ ব্যবহারের পূর্ণ অভিজ্ঞতা পান তা নিশ্চিত করতে তারা বিনিয়োগ করেছে। যার অর্থ কেবল নেভিগেশন এবং বিভাগগুলোই নয়, পর্যালোচনা, পণ্যের বিষয়বস্তু এবং অন্যান্য সবকিছুই আমাদের মাতৃভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে।
শেষ কথা
দারাজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ই-কর্মাস প্ল্যাটফর্ম। নানা অভিযোগ, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার পরেও দারাজ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ভালো পরিষেবা প্রদান করার। শূন্য থেকে শুরু করে আজকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছানো দারাজের যাত্রা বহু অনলাইনভিত্তিক কোম্পানির জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
Comments