Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা ইসফাকুল কবির |
বিশ্বব্যাপী গাড়ি শিল্পে একটি বারবার উচ্চারিত নাম টয়োটা। জাপানের ছোট্ট একটি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আজকে টয়োটা বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। টয়োটা তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল সময়ে। তবে বর্তমান সময়ে টয়োটা মানুষের কাছে একটি আস্থার নাম। বাংলাদেশেও টয়োটা গাড়ি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিন্তু কীভাবে এই কোম্পানি এত বড় হয়ে উঠল? তাদের সফলতার মূলে কী? তাদের সাফল্য এবং বাংলাদেশে তাদের প্রভাবের গল্প জানবো এই আর্টিকেলের মধ্য দিয়ে।
টয়োটার যাত্রা এক অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প
টয়োটার শুরুটা হয়েছিল বেশ অন্যরকম। ১৯৩৩ সালে জাপানের এক উদ্ভাবনী মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তি কিচিরো টয়োডা তার টেক্সটাইল কোম্পানিতে গাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করেন। তারপর ১৯৩৬ সালে টয়োটা প্রথমবারের মতো তাঁদের যাত্রীবাহী গাড়ি মডেল “এএ সেডান” তৈরি করে। এই গাড়িটি তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতার পরিচয় দেয়। ১৯৩৭ সালে টয়োডা মোটর কোম্পানি আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ে কোম্পানির নামকরণে জাপানি ভাষায় “টয়োটা” থেকে “টয়োডা” করা হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টয়োটা সামরিক যানবাহন তৈরি করলেও যুদ্ধের পরপরই তারা আবার যাত্রীবাহী গাড়ি তৈরিতে মনোযোগ দেয়। এরপর ১৯৬৬ সালে “টয়োটা করোলা” বাজারে আসে, যা আজও বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত গাড়ি।
বৈশ্বিক সাফল্যের যাত্রা
টয়োটা গাড়ি বর্তমানে ১৭০টিরও বেশি দেশে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে। বিশ্ব জুড়ে গাড়ি বিক্রি করে টয়োটা প্রতিবছর প্রায় ৪৬.৪ ট্রিলিয়ন ইয়েন (৩১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) আয় করছে। বর্তমানে টয়োটা মোটর কর্পোরেশন বিশ্বের ৬৭টি দেশ ও অঞ্চলে তাদের নিজস্ব উৎপাদন কারখানা পরিচালনা করছে। যার ফলে টয়োটা প্রায় ৩.৩ লক্ষ ব্যক্তিকে চাকরি দিতে সক্ষম হয়েছে। টয়োটা তাদের “জাস্ট-ইন-টাইম” উৎপাদন কৌশল এবং মানসম্পন্ন গাড়ির জন্য পরিচিত, যা তাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখে। অন্যদিকে “টয়োটা প্রিয়াস” বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল হাইব্রিড গাড়ি। এই হাইব্রিড গাড়ি তৈরির প্রযুক্তি টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা গড়ার প্রতীক হয়ে উঠেছে অন্যান্য গাড়ি নির্মাতাদের কাছে।
জাপানের অর্থনীতিতে টয়োটার প্রভাব
জাপানের অর্থনীতিতে অন্যতম আস্থার নাম টয়োটা। এটি জাপানের মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) ২%-এরও বেশি অবদান রাখে। কোম্পানিটি স্থানীয় কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস এবং জাপানের বৈদেশিক বাণিজ্যে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। এছাড়া টয়োটার উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং বৈশ্বিক কার্যক্রম জাপানের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে শক্তিশালী করেছে। টয়োটার বার্ষিক রাজস্ব এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন জাপানের অর্থনীতিকে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। এছাড়া জাপানের প্রতি আস্থা তৈরি করতে টয়োটা বিশেষ ভুমিকা পালন করে। জাপান বলতেই মানুষ উন্নত মানের গাড়ি এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় সব উৎপাদনের কেন্দ্র স্থল বলে মনে করে।
বাংলাদেশে টয়োটার আগমন ও জনপ্রিয়তা
টয়োটা ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে একটি জনপ্রিয় গাড়ির ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। বিশেষ করে জাপান থেকে কিছুদিন ব্যবহার হয়ে আসা গাড়ির চাহিদা বাংলাদেশের মানুষের কাছে ব্যপক। তাই রিকন্ডিশন গাড়ি বাজারে বিশেষভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এই ধরণের গাড়িগুলোর মধ্যে আছে, প্রিমিও, করোলা, এবং অ্যালিয়ন মডেলগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানুষ টয়োটার গাড়ি পছন্দ করেন এর টেকসইতা, কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং মানসম্পন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য।
টয়োটার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
টয়োটা ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। কোম্পানির প্রেসিডেন্ট কোজি সাতো জানান, তারা বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির প্রযুক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ১০টি নতুন বৈদ্যুতিক মডেল উন্মোচনের পরিকল্পনা করছে তারা। এছাড়াও প্রতিবছর ১.৫ মিলিয়ন বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির লক্ষ্য রয়েছে তাদের।টয়োটা হাইড্রোজেন-চালিত ইঞ্জিনের উন্নয়নে কাজ চালাচ্ছে এবং স্মার্ট চার্জিং নেটওয়ার্ক তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। সাতো বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু কার্বন নিরপেক্ষতা নয়, বরং গাড়ির মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।”
বর্তমান সময়ে, টয়োটা শুধু গাড়ি শিল্প নয়, পরিবেশ সুরক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে যে, টয়োটার প্রতি মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসা কেবল তাদের পণ্য নয়, তাদের নীতির প্রতিও।
Comments