ইনভেস্টমেন্ট স্ট্রাটেজিস

ওয়ারেন বাফেট: বিনিয়োগ জগতের এক কালজয়ী নাম

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা ইসফাকুল কবির

ওয়ারেন বাফেটকে বলা হয় “ওমাহার অরাকল” তিনি শুধু একজন সফল বিনিয়োগকারীই নন, বরং বিনিয়োগ জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তি। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সিইও এবং চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন, তা আজ কোটি বিনিয়োগকারীর অনুপ্রেরণা। আসুন, তার জীবন এবং বিনিয়োগ দর্শনের কিছু গভীর দিক সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। 

বিনিয়োগে মূল্যবোধের গুরুত্ব

ওয়ারেন বাফেট তার বিনিয়োগ দর্শনে একটি সরল কিন্তু শক্তিশালী মন্ত্র দিয়েছেন: “প্রাইস ইজ হোয়াট ইউ পে, ভ্যালু ইজ হোয়াট ইউ গেট” “। অর্থাৎ, আপনি যেটির জন্য মূল্য দিচ্ছেন সেটি আসলে তার প্রকৃত মান বোঝায় না। একটি ভালো বিনিয়োগ হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়া, যার প্রকৃত মূল্য ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।

ওয়ারেন বাফেট তার দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ দর্শন অনুযায়ী এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন যেগুলোর রয়েছে শক্তিশালী আর্থিক অবস্থা, বাজারে সুনাম, এবং দীর্ঘকাল ধরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ইতিহাস। বাফেটের কিছু সবচেয়ে সফল বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে:

  1. কোকা-কোলা (Coca-Cola): ১৯৮৮ সালে বাফেট কোকা-কোলায় বিনিয়োগ করেন প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার। এটি ছিল তার সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্তগুলোর একটি, কারণ আজও কোকা-কোলা তার অন্যতম লাভজনক সম্পদ। এর বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
  2. আমেরিকান এক্সপ্রেস (American Express): ১৯৬০-এর দশকে বাফেট ১৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন এখানে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য এত পরিমাণে বেড়েছে যে বাফেটের এখান থেকে আয় করেছেন কয়েক বিলিয়ন ডলার।
  3. অ্যাপল (Apple): ২০১৬ সালে বাফেট প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে অ্যাপলে বিনিয়োগ করেন।  আজ অ্যাপলের শেয়ার থেকে বাফেট বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করছেন।
  4. ব্যাংক অব আমেরিকা (Bank of America): ২০১১ সালে, ব্যাংক অব আমেরিকায় ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন বাফেট। সেই সময় ব্যাংকটির শেয়ার মূল্য কম ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তা বেড়ে যায়, এবং এখন বাফেটের বিনিয়োগ থেকে বিপুল লাভ হয়েছে।

এই সফল বিনিয়োগগুলি বাফেটের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যেখানে তিনি শুধুমাত্র আস্থাশীল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন, যেগুলোর বাজারে শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে এবং এগুলোর ভবিষ্যত প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিক। তার এই দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ কৌশল তাকে সময়ের সাথে সাথে এনে দিয়েছে প্রচুর মুনাফা এবং তাকে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।

ওয়ারেন বাফেটের বিনিয়োগ দর্শন প্রতিফলিত করে, যেখানে বিনিয়োগে মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে

ওয়ারেন বাফেট – বিনিয়োগে মূল্যবোধের গুরুত্বের প্রতীক, যিনি বিনিয়োগের জগতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। | ছবি সংগৃহীত।

বাজারের উত্থান-পতন সম্পর্কে জ্ঞান রেখে বিনিয়োগ

বাফেটের অন্যতম আলোচিত উক্তি: “বি ফেয়ারফুল হোয়েন আদারস আর গ্রেডি অ্যান্ড গ্রেডি হোয়েন আদারস আর ফেয়ারফুল”।তিনি বিশ্বাস করেন, যখন সবাই আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে, তখন প্রকৃত বিনিয়োগকারীর উচিত সুযোগ খুঁজে নেওয়া।

উদাহরণ হিসেবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় তিনি ব্যাংক অব আমেরিকা এবং গোল্ডম্যান স্যাকসের মতো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। আজ সেই বিনিয়োগগুলো তার অন্যতম লাভজনক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত।

বিনিয়োগে গুণগত মানের অগ্রাধিকার

ওয়ারেন বাফেটের আরেকটি প্রিয় উক্তি হলো ,“একটি প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান বিনিয়গের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ”। তিনি বিশ্বাস করেন, দুর্বল আর্থিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও সস্তা দামে কোম্পানি কেনা ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ওয়ারেন বাফেটের বিনিয়োগ দর্শন প্রতিফলিত করে, যেখানে বিনিয়োগে গুণগত মানের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

ওয়ারেন বাফেট – বিনিয়োগে গুণগত মানের অগ্রাধিকার, যিনি বিনিয়োগ জগতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। | ছবি সংগৃহীত।

বাফেটের বিনিয়োগ নিয়ম

বিনিয়োগের জগতে বাফেটের কিছু কঠোর নিয়ম তাকে আজকের অবস্থানে এনেছে:

১. কখনো মূলধন হারাবেন না:
তার বিনিয়োগের প্রথম এবং প্রধান নিয়ম হলো, “নিয়ম ১: কখনো টাকা হারাবেন না। নিয়ম ২: কখনো নিয়ম ১ ভুলবেন না।” তিনি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ এড়িয়ে চলতে বলেছেন এবং পুঁজির সুরক্ষার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে বলেছেন।

২. দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি:
ওয়ারেন বাফেট তার বিনিয়োগকে দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে বিবেচনা করেন। এটি তার ধৈর্যশীল বিনিয়োগ কৌশলকে প্রতিফলিত করে।

৩. যা বোঝেন তাতেই বিনিয়োগ করুন:
তিনি মনে করেন, যে শিল্প বা কোম্পানিকে আপনি ভালোভাবে বোঝেন না, সেখানে বিনিয়োগ করা বোকামি।  বাফেটের মতে, সঠিক গবেষণা এবং জ্ঞানের ভিত্তিতেই বিনিয়োগ করা উচিত।

ওয়ারেন বাফেটের বিনিয়োগ দর্শন প্রতিফলিত করে, যেখানে "যা বোঝেন তাতেই বিনিয়োগ করুন" মূলমন্ত্র প্রকাশ পায়।

ওয়ারেন বাফেট – যা বোঝেন তাতেই বিনিয়োগ করুন: বিনিয়োগে জ্ঞান ও সচেতনতার গুরুত্বের পরিচায়ক। | ছবি সংগৃহীত।

বাফেট কীভাবে ধনী হলেন?

বাফেটের বিনিয়োগ জার্নি শুরু হয় তার শৈশব থেকেই। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি প্রথম শেয়ার কেনেন এবং এরপর থেকে তার আর্থিক বুদ্ধিমত্তা ক্রমাগত বেড়ে ওঠে। কোকা-কোলা, ব্যাংক অব আমেরিকা, এবং অ্যাপলের মতো বড় কোম্পানিগুলোতে তার বিনিয়োগ আজ কোটি কোটি ডলারের মুনাফায় রূপ নিয়েছে। 

বর্তমান বিনিয়োগ কৌশল

আজও ওয়ারেন বাফেট তার মূল নীতিগুলো অনুসরণ করেন। তবে প্রযুক্তি খাতে তার নতুন আগ্রহ লক্ষণীয়। অ্যাপল, আমাজন, এবং তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টরের মতো কোম্পানিতে তার বিনিয়োগ তার কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। তার পোর্টফোলিওতে আজও আছে তেল-গ্যাস কোম্পানি এবং কোকা-কোলার মতো ক্লাসিক কোম্পানি। তবে, তার মূল দর্শন অটুট—গুণগত মানের প্রতিষ্ঠান এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি।

ওয়ারেন বাফেটের বিনিয়োগ দর্শন শুধুমাত্র আর্থিক সাফল্যের মাপকাঠি নয়, এটি আমাদের শেখায় ধৈর্য এবং দূরদর্শিতার মূল্য। তার জীবনের গল্প এবং বিনিয়োগ কৌশল থেকে আমরা যে কেউ নিজের জীবনে প্রেরণা নিতে পারি। বাফেট প্রমাণ করেছেন, সঠিক জ্ঞান, পরিশ্রম, এবং দূরদর্শিতা থাকলে যে কেউ সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে পারে।

“তথ্যসূত্র”

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ক্যামেরাঃ ইনস্টা৩৬০ গো ৩

Previous article

জেনে নিন নতুন প্রযুক্তি ব্লকচেইন সম্পর্কে

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *