Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়শা মারিয়া |
কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ বর্তমানে একটি উঠতি উদ্বেগ। আমরা জানি সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজন আয়- উপার্জন আর এজন্য কর্মজীবী মানুষ দিনের উল্লেখযোগ্য সময় কাটায় নিজস্ব কর্মস্থলে। দৈনিক ঘুমের বাইরে যেসময়টুক একজন মানুষের হাতে থাকে তার সিংহভাগই কাটাতে হয় কর্মস্থলে।
একজন কর্মজীবী মানুষকে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে প্রতিদিন দৌড়াতে হয় তার সেই একক ঠিকানায়, লম্বা সময়ের জন্য একটানা বসে থাকতে হয় চার দেয়ালের মাঝে কিংবা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘন্টা, সকাল ৯টা হতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারিত থাকলেও কখনো সেটা রাত ৯টা পর্যন্ত ও গড়ায়।
ভিন্ন কর্মের লোকের কাজের চাপও ভিন্ন রকম হয়। তবে সবসময় অতিরিক্ত চাপ থাকে এমন কাজ যেখানে নেহাত কোনো ছোট ভুল কারো জীবনের জন্য হতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ! তাই এসব কাজে অংশগ্রহণের পুর্বেই মানসিক প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন যেন কাজের অতিরিক্ত চাপ কোনরকম শরীর বা মনের জন্য ক্ষতিকর না হয়ে পড়ে।
আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ স্ট্রেস দেখেছে যে বর্তমানে ৭৫ শতাংশ কর্মচারি বিশ্বাস করেন যে তাদের আগের প্রজন্ম’র তুলনায় তারা চাকরির সময় বেশি চাপে থাকছে এমনকি প্রতি ৪ জন কর্মচারির মধ্যে প্রতি ১ জন কর্মচারী চাকরিকে তাদের জীবনের এক নম্বর চাপ হিসেবে দেখছেন।
কর্মস্থলের বাহিরেও কেউ কাজ নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকাকে নিজস্ব রুটিন বানিয়ে নিয়েছে যা একই সাথে কাজের মানের ক্ষতি থেকে শুরু করে শরীর, মন এবং চিন্তাশক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্থ করছে। যা পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কেরও অবনতি ঘটতে পারে। এমনকি অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার পরও ব্যক্তিগত সময় গুলোতেও এর রেষ থেকে যায় যা পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টির কারণ হয়।
বদমেজাজি বস, কাজ সম্পাদনে সংক্ষিপ্ত সময়সীমা, দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ না পাওয়া, অন্তহীন কাগজপত্র, ঘন্টার পর ঘন্টা অফিস মিটিং, অফিস বসের দেওয়া আলাদা কাজের চাপ, অল্পতেই রেগে যায় এমন গ্রাহকদের সামলানো, সহকর্মীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ এবং যেকোনো সময় চাকরি চলে যাওয়ার ভয় এসব নানা কারনে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তবে একেক জন আবার কাজের প্রতিক্রিয়া দেখায় একেক মাত্রায়। যদিও মানসিক চাপের মোকাবিলা করার ধরন এবং উপসর্গ ব্যক্তিভেদে ও তাদের কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়।
চলুন জেনে নিই কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের চাপ যেসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ঘটাতে পারেও
মাথাব্যথা, ক্লান্তি, সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্টে সমস্যা, অনিদ্রা, দুশ্চিন্তা, বদহজম, হৃদরোগ, পিঠে ব্যথা, বিষন্নতা, দীর্ঘস্থায়ী পেশিতে ব্যথা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়া।
গবেষনা দেখায় যে কর্মক্ষেত্রে চরম চাপ সৃজনশীলতা ও কাজ করার আগ্রহকেও বাধাগ্রস্ত করে থাকে। এছাড়াও অত্যধিক চাপের কর্মচারীরা দলগত কাজে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হতে পারে এমনকি তাদের কর্মদক্ষতাও হ্রাস পেতে পারে।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এক ভ্রান্ত ধারণা সর্বদা কাজ করে এবং সেটি হলো সফলতার চাবিকাঠি বলা যায় অতিরিক্ত কাজের চাপের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা তবে এধরনের চিন্তা ঝেড়ে ফেলাই উত্তম। কারণ অতিরিক্ত কাজের চাপ কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুকি তো বাড়াচ্ছেই এমনকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের মুনাফার দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রের অত্যধিক চাপে কেউ মানসিক চাপ অনুভব করলে তার জন্য আমার পরামর্শ হবে একজন স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টে বিশেষজ্ঞ’র পরামর্শ নেওয়া।
কাজের চাপ কমানো এবং অবসাদগ্রস্থতা এড়িয়ে চলতে আপনি যা করতে পারেনঃ
১) আপনাকে বাস্তবতা যাচাই করতে হবে যে আপনার উপর যে কাজের উচ্চ চাপ রয়েছে তা আপনার মনে আদৌ চাপ সৃষ্টি করছে কি না, আপনি কতটুক চাপ সামাল দিতে পারবেন। তাই আপনাকে বাস্তবতা যাচাই করতে হবে।
২)সঠিক সময়ে কাজ শেষ করা এবং কোন কাজ আগে শেষ করবেন অর্থাৎ অগ্রাধিকার ব্যবস্থাপনা কর্মক্ষেত্রে অনেক চাপ কমাতে পারে।
৩) আপনি প্রতি ঘন্টায় ছোট ছোট ব্রেক নিতে পারেন এতে আপনার কাজের একঘেয়েমিতা কেটে যাবে।
৪) আপনি সামলাতে পারেন তার চেয়ে বেশি কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বন্ধ করুন। আপনার যেমন কখনো বলার প্রয়োজন হতে পারে, “দুঃখিত। আমার কাজের চাপের কারনে আমি এই সময়ে বেশি কিছু নিতে পারছি না।”
৫) প্রতিদিন বিশ্রামে কিছু সময় কাটানোর পরিকল্পনা করতে হবে তবে না ঘুমিয়ে কোনো আরামদায়ক চেয়ারে বসুন, আপনার চোখ বন্ধ করে কিছু সুন্দর মুহুর্ত কল্পনা করুন।
৬) পুষ্টি এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আপনার প্রতিদিনের খাবারের মেনুতে প্রচুর তাজা ফল এবং শাকসবজি এবং জল অন্তর্ভুক্ত করুন। প্রতিদিন কাজ করার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর খাবার মেন্যু নির্ধারন করুন।
৭) কর্মক্ষেত্রে আপনার চাপ সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলো সম্পর্কে কাজের বাইরে কোনও পরিবারের সদস্য বা বন্ধুর সাথে কথা বললে অনেকসময় তা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারে। সমস্যাগুলো তখন একসাথে মিলে মোকাবেলা করার সুযোগ আসবে এবং সমাধান অন্বেষন করা সহজ হবে।
৮) পর্যাপ্ত ঘুম শরীর এবং মন উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম আমাদের শরীরকে তরতাজা রাখে, শিথিল করে এবং পুনরুজ্জীবিত করে এবং স্ট্রেসের প্রভাবক নিরসনে সাহায্য করতে পারে।
৯) নিয়মিত দৈনিক ব্যায়্যাম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এর মধ্যে হাঁটা, সেইসাথে আরও নিবিড় কিছু ব্যায়াম অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
আমাদেরকে যদিও সকল কাজে উৎসাহিত করার জন্য এবং আমাদের কাজগুলি সঠিক সময়ে ও সুষ্ঠু ভাবে শেষ করতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের চাপের প্রয়োজন হয় স্বাভাবিক ভাবেই তবে স্ট্রেস পরিচালনা করার মূল চাবিকাঠি যদি এক কথায় বলতে যাই তা হবে “ভারসাম্য”। যখন কর্মীরা ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করে খুশি হয় তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং মন ও শরীর ও সুস্থ থাকে। যা তাদের যথাসময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়া ও সৃজনশীল উপায়ে কাজ করতে সাহায্য করে।
Comments