Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আনিকা তায়্যিবা |
ইয়েনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বিশ্বের সবচেয়ে দামি মুদ্রা কাতারের দিনার বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন ডলার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়তো লোকমুখে সবসময়ই থাকে, সেই তুলনায় জাপানি ইয়েনের কথা আমরা খুব একটা শুনিনা। তবে বর্তমানে বেশ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট এই দেশটির সরকারী মুদ্রা তথা সর্বোপরি অর্থনৈতিক অবস্থা। জাপানি ইয়েন ১৮৭১ সালে মেইজি পুনর্গঠনের সময় চালু হয়। এটি জাপানের অর্থনৈতিক আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে জটিল ফিউডাল মুদ্রা ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি ভিন্নধর্মী মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। শুরুতে স্বর্ণ ও রুপার মানের উপর ভিত্তি করে ইয়েনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা হত। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতি মার্কিন ডলার সমান ৩৬০ ইয়েন নির্ধারিত হয়েছিল, যা জাপানের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে বেশ সহায়ক ছিল।
প্রায় এক শতক পরে ১৯৭১ সালে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার পতনের পর ইয়েন ভাসমান বিনিময় হারে চলে আসে। ১৯৮০-এর দশকে জাপানে রপ্তানিভিত্তিক অর্থনীতির উত্থান হয়, ফলে ইয়েনের মান দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে পরের দশকে অর্থাৎ ১৯৯০-এর দিকে বিশাল শেয়ার বাজার ধ্বস ইয়েনকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থবিরতার দিকে ঠেলে দেয়।
ইয়েনের মূল্যমানের ক্রমশ অস্থিরতা
কোন একটি নির্দিষ্ট নয় বরং ইয়েনের মানের অস্থির উঠানামা বেশ কয়েকটি কারণের উপর নির্ভরশীল। যেমন:
১. নিরাপদ মুদ্রার অবস্থান
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় ইয়েনের মান বৃদ্ধি পায়, যা জাপানের রপ্তানি অর্থনীতির সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে।
২. নিজস্ব অর্থনৈতিক নীতি
জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহজ মুদ্রানীতি, যেমন ঋণাত্মক সুদের হার এবং বন্ড ক্রয়, ইয়েনের মানকে দুর্বল করে দিয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের হার কার্যকর করছে, যা বিনিয়োগকারীদের সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
৩. বাণিজ্য এবং জ্বালানি নির্ভরতা
জাপান জ্বালানি আমদানির উপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এর বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও কম রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ইয়েনের প্রবাহকে সীমিত করেছে। যার ফলে বাজারে ইয়েনের মানে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান পতনের কারণ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপানি ইয়েনের মান ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর কারণগুলো হলো:
১. সুদের হারে পার্থক্য
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ উচ্চ সুদের হার কার্যকর করছে, যেখানে জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনও নিম্নহার বজায় রেখেছে।
২. দেশের জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা
জাপানের বয়স্ক জনসংখ্যার আধিক্য এবং কম অভ্যন্তরীণ চাহিদা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। যা ইয়েনের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমাচ্ছে।
৩. ভুরাজনৈতিক সমস্যা
দুর্বল ইয়েন সাধারণত দেশের রপ্তানিকে সুবিধা দেয়, কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও প্রতিযোগিতা ইয়েনের দুর্বল মানের ফলে সীমিত হয়েছে। তাই এই বৈশ্বিক ঝুঁকির সময় নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে ইয়েনের ভূমিকাও হ্রাস পাচ্ছে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
জাপানের নীতিগুলো মুদ্রাস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য রাখলেও, কাঠামোগত সংস্কার ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ইয়েনের অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকবে। ইয়েনের অস্থিরতা বৈশ্বিক বাণিজ্য ও আর্থিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে ইতোমধ্যেই।
জাপানি ইয়েনের পতনের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একটি মুদ্রার স্থিতিশীলতা অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত কারণগুলোর উপর কতটা নির্ভর করতে পারে। তাই শুধু অভ্যন্তরীণ নয় বরং আন্তর্জাতিক নীতির মিশ্রণে একটি মুদ্রার স্থিতিশীলতা নির্ধারণে জাপান সরকারের কাজ করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । ইয়েনের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে জাপান কীভাবে তাদের কাঠামোগত সংস্কার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সেটার উপর।
Comments