কারেন্সী

কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা হলো বৈশ্বিক মুদ্রা?

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আনিকা তায়্যিবা

যদি সার্বজনীন মুদ্রার কথা বলি যা আপনি যেখানে চাইবেন ব্যবহার করতে পারবেন, আপনার মাথায় কোন মুদ্রার নাম আসবে? অবশ্যই মার্কিন ডলার! কখনও ভেবে দেখেছেন কোনো দেশের মুদ্রা কতটা শক্তিশালী বা দুর্বল তাও কিন্তু তুলনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী মুদ্রা অর্থাৎ মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে। কিন্তু কেন? কীভাবে মার্কিন ডলার বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে? কেন আমরা নিজ দেশের বাইরে যেখানেই যাই না কেন মার্কিন ডলার সাথে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এটি কোনো সহসা অর্জন নয়; বরং দীর্ঘ সময় ধরে ইতিহাসের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা, সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিক গতিবিধির কারণে মার্কিন ডলার আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। চলুন জানা যাক আজ এই সম্পর্কেঃ

মার্কিন ডলারের উৎপত্তি

মুদ্রা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, মার্কিন ডলারের উৎপত্তি।

মার্কিন ডলারের উৎপত্তি, মুদ্রার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। | ছবি সংগৃহীত।

মার্কিন ডলারের ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এর গোড়াপত্তন হয় উপনিবেশিক যুগে। ১৬৯০ সালে ম্যাসাচুসেটস বে কলোনি যখন প্রথম কাগজের মুদ্রা প্রচলন করে, তখন তা মূলত সামরিক খরচ নির্বাহের জন্য ব্যবহৃত হত। তবে ১৭৮৫ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের চিহ্নটি গ্রহণ করা হয়, যা স্প্যানিশ আমেরিকান পেসোর থেকে অনুপ্রাণিত। এর পরিপূর্ণ রূপটি আসে ১৯০০ সালের শুরুতে, বিশেষ করে ১৯১৪ সালে, যখন ফেডারেল রিজার্ভ অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর কেন্দ্রীয়ভাবে ডলার মুদ্রণ শুরু হয়।

সোনার মুদ্রার যুগ এবং এর পরিবর্তন

মুদ্রার ইতিহাসে সোনার মুদ্রার যুগ এবং এর পরিবর্তন।

সোনার মুদ্রার যুগ এবং এর পরিবর্তন, মুদ্রার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। | ছবি সংগৃহীত।

২০ শতকের শুরুর দিকে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশ সোনার সাথে তাদের মুদ্রাকে সংযুক্ত করে এক ধরণের স্থিতিশীল বিনিময় হার নিশ্চিত করত। তবে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেক দেশ সোনার মানদণ্ড স্থগিত করে এবং সামরিক খরচ চালাতে কাগজের মুদ্রার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পথ সুগম হয়। এ সময় ব্রিটেনসহ অন্যান্য অনেক দেশ বিপুল অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হয়

বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন অর্থনৈতিক শক্তি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্র শক্তিদের অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রধান দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। মিত্র দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে সোনা দিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে থাকে, যার ফলে যুদ্ধের শেষে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম সোনা রিজার্ভের মালিক হয়ে ওঠে। এর ফলে, যুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশেষ স্থান অর্জন করে।

ব্রেটন উডস চুক্তি

১৯৪৪ সালে, ৪৪টি মিত্র দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস নামক জায়গায় একটি বৈঠক করেন। সেখানে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থার একটি নতুন কাঠামো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়, যা ব্রেটন উডস চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন ডলারের বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী দেশগুলোর মুদ্রা আর সোনা সরাসরি বিনিময় না করা গেলে মার্কিন ডলারের সাথে বিনিময় বৈধ ছিল।

মার্কিন ডলারকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান

ব্রেটন উডস চুক্তির ফলে মার্কিন ডলার আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। অন্যান্য দেশগুলো তাদের ডলারের রিজার্ভ বাড়াতে শুরু করে এবং সেই রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য তারা মার্কিন ট্রেজারি সিকিউরিটি কিনে নিতে থাকে। তবে ১৯৭১ সালে, ডলারের প্রতি আস্থা কমতে শুরু করলে দেশগুলো তাদের ডলারের মজুদ সোনায় রূপান্তর করতে থাকে। তবে এর পরও মার্কিন ডলার তার বৈশ্বিক মুদ্রার অবস্থান ধরে রাখে।

মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি প্রদান।

মার্কিন ডলারকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, মুদ্রা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। | ছবি সংগৃহীত।

বর্তমানে মার্কিন ডলারের অবস্থান

এখনও মার্কিন ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে বজায় আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অনুযায়ী, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভের একটি বড় অংশ ডলারে সংরক্ষণ করে থাকে, যা আনুমানিক ৫৯% এর সমান। পরবর্তীতে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে দেশগুলো এই ডলার বিক্রি করে বা দ্রব্যপণ্য আমদানীর ক্ষেত্রে কাজে লাগায়।

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনশীল, তাই ভবিষ্যতে মার্কিন ডলার রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে এর অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। ডলারের পরে দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রা হলো ইউরো যা একদিন হয়তো ডলারকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। তবে এর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ বিভাগের অভাব বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করছে। 

উপনিবেশিক যুগ থেকে ব্রেটন উডস চুক্তি পর্যন্ত ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে আজ এই শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। যদিও সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে মার্কিন ডলার এখনো বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান রিজার্ভ ও বিনিময় মুদ্রা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

“তথ্যসূত্র”

ভারতের গ্লোবাল আইকন রতন টাটা যেভাবে গড়লেন ‘টাটা গ্রুপ”

Previous article

টেকসই উন্নয়নের রূপকার বাংলাদেশের এই ১০ টি প্রতিষ্ঠান

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *