Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা ইসফাকুল কবির |
‘আপনার দরিদ্র হয়ে জন্মানোটা দোষের না কিন্তু দরিদ্র হয়ে থাকাটাই দোষের। আপনি যদি একটি দরিদ্র ঘরে জন্ম নিয়ে নিজের ৩৫ বছর বয়সেও সেই দরিদ্রই থাকেন। তবে দরিদ্র হয়ে থাকাটা আপনার কপালের দোষ নয়, আপনি এটারই যোগ্য।’ এই বিশ্বসেরা উক্তিটি দিয়েছিলেন জ্যাক মা। যিনি অনলাইন ভিত্তিক শপিং প্রতিষ্ঠান আলি বাবার প্রতিষ্ঠাতা। আজ জানব তার সম্পর্কে।
আলিবাবা ডট কম বিশ্বের সবথেকে বড় অনলাইন ভিত্তিক শপিং প্লাটফর্ম। যার বর্তমান মূল্য ২৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে আলিবাবা ব্যাবহারকারীর সংখ্যা এমাজন এবং ইবেয় কে ছাড়িয়ে গেছে। মজার ব্যপার হলো আলিবাবার মূল্য ফেসবুকের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে এত বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি একদিনে হননি এমনকি এত কিছু তিনি পারিবারিক সুত্রেও পাননি।
জ্যাক মা-এর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের একটি শহর হ্যাংজুতে মধ্যবিত্ত পরিবারে জ্যাক মা ছিলেন তার মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। ছোটবেলা থেকেই জ্যাক মার ইংরেজি ভাষার প্রতি ছিল বিশেষ আগ্রহ। তিনি শুধু ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য তার শহরে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটকদের সাথে ট্যুর-গাইড হিসেবে কাজ করতেন। বিনিময়ে তিনি কোন অর্থ নিতেন না। জ্যাক মা পরবর্তীতে হ্যাংজু নর্মাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি মাত্র ১২ ডলারের মাসিক বেতনে হ্যাংজু কিয়ানজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতেন। তবে চীনের শীর্ষ ধনী জ্যাক তার বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন তিন তিন বার। তাই বলা যায় যে ই-কমার্স জায়ান্ট আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা-এর জীবন কোন মতেই সহজ ছিল না।
জ্যাক মা-এর পথ চলা
জ্যাক মা সম্ভবত তার জীবনের প্রতিটা পদ থেকে কিছুনা কিছু শিখেছেন। কারণ তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যে প্রথমিক পরীক্ষাতে ফেল করেছিলেন দুইবার, মাধ্যমিকে তিনবার। এমন অবস্থা হয়ত অন্য কারো সাথে হলে সে জীবনের প্রতি আশা হারিয়ে ফেলত। জ্যাকের পেশা গত জীবনও পানির মত সহজ ছিল না।
একবার তিনি কেএফসিতে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। সেখানে শুধুমাত্র জ্যাক ছাড়া সবার চাকরি হয়েছিলো। তিনি চীনের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে গিয়েও একই রকম ফলাফলের সম্মুখীন হন। তাই বলাই যায় ব্যর্থতা এবং প্রত্যাখ্যান তার জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
জ্যাক মা প্রথমবার আমেরিকা যান ১৯৯৫ সালে চীন সরকারের একটি হাইওয়ে প্রকল্প নিয়ে। সেখানে তিনি আবিষ্কার করেন কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের। ইন্টারনেটে তিনি চীন সম্পর্কে সার্চ দেন যাতে তিনি কোন আশা অনুরূপ ফল পাননি। তাই তিনি ‘চায়না পেজ’ নামে একটি ওয়েবসাইট খুলেন। যা ছিল চীনের প্রথম দিকের ওয়েব-ভিত্তিক ব্যবসাগুলির মধ্যে একটি। যদিও তখনকার সময় চীনে ব্যক্তিগত কম্পিউটারের সংখ্যা ছিল নগণ্য।
গ্লোবাল ই-কমার্স জায়ান্ট হয়ে ওঠা
এমন কোম্পনি গুলির সাফল্যের চাবিকাঠি তার দলের উৎপাদনশীলতার মধ্যে নিহিত থাকে। অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকার ফলেও জ্যাক মা অনলাইনে শপিং করার ব্যাপারটাকে ধীরে ধীরে মানুষের কাছে সহজবধ্য করে তুলেন এবং মানুষের আস্থা অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে ৩১ বছর বয়সে জ্যাক তার ১৭ জন বন্ধুদের তার কোম্পানিতে আমন্ত্রন জানায়। তাঁদের সবাই মিলে প্রতিষ্ঠা করে আলিবাবা। বৃহত্তম ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের যাত্রা হয়েছিল জ্যাকের বাসায়। এর পর তাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল আলিবাবার জন্য বিনিয়োগ নিয়ে আসা। এই ব্যাপারে তারা সফলতা পেয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে সফ্টব্যাঙ্ক থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার এবং গোল্ডম্যান শ্যাক্স থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার। আপাত দৃষ্টিতে এই পরিমান অর্থকে কম মনে হলেও টা আলিবাবার সফলতার জন্য বিশেষ ভুমিকা রেখেছিল। বর্তমানে যার বাজার মূল্য ৫০০ বিলিয়নের বেশি।
জ্যাক মা সম্পর্কে মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি যে এত বড় একটি ই-কমার্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন তবে তার ছিল না কোডিং বা প্রোগ্রামিং সম্পর্কিত কোন জ্ঞান। তিনি চীনে প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স কোম্পানিগুলির কাছ থেকে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হন। তবে জ্যাক তার গ্রাহকদের জন্য ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতা দেয়ার উপর মনোনিবেশ করেছিলেন। যা আলিবাবাকে সফলতার পথ দেখাতে সাহায্য করেছিল।
জ্যাক মা-এর দর্শন ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
জ্যাক মা এর সাফল্যের অন্যতম রহস্য হল তার দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে একটি ব্যবসায় সফল হতে চাইলে শুধু অর্থ উপার্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত নয়। তিনি সবসময় এমন কাজ করতে চায়তেন যা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। জ্যাক মা আরও বিশ্বাস করতেন যে প্রযুক্তির ইতিবাচক শক্তি দিয়ে পুরো দুনিয়ার পরিবর্তন করা সম্ভব। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শন বছরের পর বছর ধরে আলিবাবার বৃদ্ধি এবং সাফল্যকে নির্দেশিত করে আসছে।
জ্যাক মা এর দর্শনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তার অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমের উপর জোর দেওয়া। তিনি বিশ্বাস করেন যে সাফল্য রাতারাতি অর্জিত হয় না, তার জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং সংকল্পের। এই বিষয়টিতে যে জ্যাক কতটা বিশ্বাসী তা বোঝা যায় তার ব্যক্তিগত জীবনের দিকে তাকালেই। কারণ তিনি আলিবাবার সফলতা অর্জনের আগে বহুবার প্রত্যাখ্যান এবং ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে সঠিক মানসিকতা এবং মনোভাব থাকলে যে কেউ সাফল্য অর্জন করতে পারে। এবং জ্যাককে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়ে চীনে অসংখ্য সফল স্টার্টআপ তৈরি হয়েছে।
জ্যাক মা-এর নেতৃত্বশৈলী
জ্যাক মা এর নেতৃত্বের শৈলী তার সাফল্যের আরেকটি রহস্য। তার নেতৃত্বের শৈলী আলিবাবাকে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সাহায্য করেছে। তার নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান দিক হলো তার দলকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা। জ্যাক মা এর নেতৃত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি তার দায়িত্বশীলতা। তার নেতৃত্বে, আলিবাবা দারিদ্র্য হ্রাস এবং শিক্ষার উন্নতির লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ চালু করে। যা কোম্পানিটিকে একটি সামাজিকভাবে সচেতন সংস্থা হিসাবে শক্তিশালী খ্যাতি তৈরি করতে সাহায্য করে। এটি তাদের ব্র্যান্ডের মূল্য আরও বাড়িয়েছে।
জ্যাক মা-এর সফলতায় ব্যর্থতার ভূমিকা
ব্যর্থতা জ্যাক মা-এর সাফল্যের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি তার সারা জীবন অসংখ্য বাধা এবং প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু তিনি কখনোই নিজেকে নিরুৎসাহিত অনুভব করতে দেননি। পরিবর্তে, তিনি তার ব্যর্থতা থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করেছেন। জ্যাক মা বিশ্বাস করেন যে ব্যর্থতা সাফল্যের বিপরীত নয়, বরং এটির একটি অংশ।
এছাড়া জ্যাক সর্বদায় অন্যদের কাছ থেকে শিখতে ইচ্ছুক। তিনি প্রায়শই স্মার্ট এবং আরও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে নিজেকে ঘিরে রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেন। এই সবকিছুই আজকের আলিবাবা তৈরিতে প্রভাব রেখেছে।
জ্যাক মা-র নজর ছিল উদ্ভাবনে
জ্যাক মা -এর সফলতার অন্যতম রহস্য হল তার উদ্ভাবনে মনোযোগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রযুক্তির দ্রুত-গতির বিশ্বে এগিয়ে থাকার জন্য ব্যাবসায় তাঁকে ক্রমাগত উদ্ভাবন করতে হবে। তবে তিনি নতুন পণ্য তৈরির জন্য নয় বরং সমস্যাগুলি সমাধান করার এবং বিদ্যমান প্রক্রিয়াগুলিকে উন্নত করার জন্য নতুন উপায় খুঁজে বের করতেন। এই কারণেই আলিবাবা গবেষণা ও উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে।
জ্যাক মা-এর বিভিন্ন সামাজিক উদ্যেগ
জ্যাক গ্রামীণ চীন থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করেন এবং বিভিন্ন ত্রাণ কর্মসূচি পালন করেন। একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুধু সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের জন্য এত কিছু করা যা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তাদের সম্মান ও প্রশংসা অর্জন করেতে সাহায্য করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় জ্যাক প্রতিষ্ঠা করেন আলিবাবা ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠান মানুষের শিক্ষার অধিকার, পরিবেশগত সুরক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য মূলক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে আসছে। এরই মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান সহ তাদের বিভিন্ন গবেষণার অর্থায়ন করে থাকে জ্যাকের এই প্রতিষ্ঠান। জ্যাকের সামাজিক এই কাজ গুলি দেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখন তাদের মডেলে এমন কাজ অন্তর্ভুক্ত করছে।
এভাবেই জ্যাক তার প্রতিষ্ঠানকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। আর জ্যাক-কে দেখে আমরা শিখতে পারি যে সফলতা রাতারাতি আসে না। এর জন্য দরকার অধ্যবসায় এবং সবসময় মনে রাখতে হবে ব্যর্থতা সফলতা অর্জনের একটি বড় অংশ। এভাবেই আলিবাবা তাদের গ্রাহক সন্তুষ্টি, সামাজিক দায়বদ্ধতার এবং উদ্ভাবনের উপর জোর দিয়ে আজ এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
Comments