Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ ইসফাকুল কবির |
বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী জনাব শেখ আকিজ উদ্দিন। আকিজ নামটির সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তিনি উদাহরণ তৈরি করে গেছেন যে কীভাবে শূন্য থেকে শুধু সততা এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে কাজ করে কোটিপতি হওয়া যায়।
জনাব আকিজের শৈশব :
খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ আকিজ উদ্দিন। তিনি তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। ছেলে ভালো কিছু করবে এই আসায় আকিজ সাহেবের বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেও তিনি খুব বেশি দিন স্কুলে যাননি। তাই তার বাবা তাঁকে ব্যবসায় লাগিয়ে দেন। পাশাপাশি তিনি তার বাবার দোকানেও সময় দিতেন। কিন্তু একদিন আকিজের বাবা তাঁকে বকাঝকা দিলে তার আকিজ রাগ করে ট্রেনে করে কলকাতা চলে যান । তখন তার বয়স চিল মাত্র ১১। মিতব্যয়ী আকিজ অলস সময় পার করছিলেন শিয়ালদহ রেল স্টেশনে।
একদিন স্টেশনের পাশে আকিজ কমলা ফল দেখে তা খুচরা বিক্রি করার চিন্তা করলেন। শুরু হলো ফল বিক্রেতা আকিজের জীবনযাত্রা। ফলের ব্যবসায় করে আকিজ তিনশ রুপি জমাতে সক্ষম হন। কলকাতার ব্যবসার পরিবেশ ভালো না দেখে তিনি চলে যান পাকিস্তানের পেশওয়ারে। এবার পেশওয়ারের ব্যবসা শেষ করে মোট ৮,০০০ টাকা মূলধন নিয়ে খুলনায় ফিরে আসেন আকিজ।
আকিজের বিড়ি উৎপাদন :
দেশে এসেও ব্যবসার ভূত তার মাথা থেকে কেউ সরাতে পারেনি। বিড়ির প্রতি তার আগ্রহ থেকে তিনি ১৯৫২ সালে নিজেই বিড়ি উৎপাদন শুরু করেন। শুরুতে তিনি বিড়ি বানিয়ে তার বন্ধুদের খাওয়াতেন। এভাবে তিনি বাজারে প্রচলিত বিড়ির চেয়ে ভিন্ন স্বাদের বিড়ি তৈরিতে সক্ষম হন। শুরুতে তিন জন শ্রমিক নিয়ে বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন।
জনাব আকিজের ব্যবসায় ভালো করার অন্যতম পন্থাও ছিল তিনি কম দামে ক্রেতাদের ভালো পণ্য সরবরাহ করতেন। তাই তিনি বাজারের প্রচলিত বিড়ির দামের চেয়ে ১ টাকা কম রাখতেন।
কীভাবে জনাব আকিজ তার ব্যবসা বড় করেনঃ
১৯৫৫ সালে তিনি বিড়ি উৎপাদনের জন্য সরকার থেকে অনুমোদন পান। ঠিক তার একবছর পর বড় পরিসরে ১৯৫৬ সাল থেকে ব্যাপক ভাবে আকিজ বিড়ি উৎপাদন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি মৌসুমি বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে পরেন যেমন গুঁড়, পাট, সোল-বুট ইত্যাদি। জনাব আকিজের কথা ও কাজে মিল থাকায় এবং তার পণ্য ভালো হওয়ায় তিনি ক্রিসেন্ট জুট মিল থেকে পাট সরবরাহ করার কাজ পান।
বর্তমান সময়ের মত সে সময়ও ব্যবসায়িকরা তাদের পণ্য সরবরাহ করতে মধ্যস্থতাকারি দের সাহায্য নিতেন। এই ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিলেন জনাব আকিজ। তার উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে তিনি নিজে বেবি ট্যাক্সি নিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতেন।
১৯৬০ সালের দিকে তার উৎপাদিত বিড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই তিনি খুলনায় ২০ বিঘা জমি এবং আরও ৫ টি বেবি ট্যাক্সি ক্রয় করতে সক্ষম হন। যার ফলে তিনি খুলনার পাশাপাশি তার আশেপাশের এলাকায় বিড়ির সরবরাহ শুরু করেন।
জনাব আকিজের সফলতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ‘শেখ আকিজ উদ্দিন ৭৭ বছর বেঁচেছেন। তার মধ্যে ৬৮ বছর ব্যবসা করেছেন। তিন বছর পিতার সঙ্গে আর বাকি ৬৫ বছর একাই ব্যবসা করেছেন। তিনি একটির পর একটি ব্যবসা করে ১৭ টাকার পুঁজি থেকে শত শত কোটি টাকার একটি শিল্পসাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।’
১৯৭১-এর যুদ্ধের পর জনাব আকিজঃ
যুদ্ধের পর দেশে হাহাকার বেড়ে যায় এবং দ্রব্য পণের দামও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। যেসময় আকিজ উদ্দিন তার গমজাত পণ্য বিক্রি করে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা লাভ করতে সক্ষম হন।
এতদিন তিনি খুলনাও তার আশেপাশের এলাকাতে বিড়ি সরবরাহ করলেও এবার তিনি ঢাকার বাজার ধরতে চান। তৎকালীন ঢাকার আরমানিটোলা বিড়ি ব্যবসার কেন্দ্র ছিল। জনাব আকিজ সেখানে ব্যবসায়ীকদের মাঝে তার বিড়ি বিনা মূল্যে বিতরণ।
তখনকার সময় ঢাকার বাজারে আকিজ বিড়ি অনেক জনপ্রিয় ছিল। তবে আকিজ বিড়ি স্বাদেও গন্ধে ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এছাড়া ১৯৭৬ সালে রেডিওতে প্রথম প্রচারিত বিড়ির বিজ্ঞাপন ছিল আকিজ বিড়ির। এবং সে বছর তার বিড়ির উৎপাদন প্রায় ৭০ লক্ষে এসে দাঁড়ায়।
চামড়া ব্যবসায় তার বেশ আগ্রহ ছিল। তবে তার এই ক্ষেত্রে অনেক জ্ঞান না থাকায় তিনি তার মেজ ছেলেকে লেদার টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করতে পাঠান যুক্তরাজ্যে।
এরপর জনাব আকিজ একের পর এক বিভিন্ন কোম্পানি বিক্রির নিলামে অংশগ্রহণ করেন এবং কোম্পানি গুলো ক্রয়ের মাধ্যমে তার ব্যবসা বড় করেন।
এছাড়া নব্বই এর দশকে তিনি বিড়ি ক্রেতাদের মাঝে ম্যাচের ব্যাপক চাহিদা দেখতে পেয়ে তিনি ম্যাচের উৎপাদন শুরু করেন। তাদের উৎপাদিত ডলফিন ব্রান্ডের ম্যাচ একসময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। ১৯৯২ সালে তিনি দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট রপ্তানিকারকের স্বীকৃতি পেলে সে বছর তিনি আকিজ জুট মিল প্রতিষ্ঠা করেন।
জনাব আকিজের কোটিপতি হওয়ার গল্পের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রহস্য অংশ তার ‘ট্রেডমার্ক’ স্কুটার। এই স্কুটি তার জীবনের এক পরিচিত ও প্রতীকী অধ্যায় হয়ে আছে। সাদামাটা জীবনযাপন করতে তিনি পছন্দ করতেন। তিনি নিজেকে তার সম্পদের কেয়ারটেকার মনে করতেন। তিনি সবসময় পরিবারে একটা কৃত্রিম সংকট রাখতেন।
বর্তমানে আকিজ গ্রুপের অধীনে টেক্সটাইল, সিমেন্ট, সিরামিক, খাদ্যপণ্য এবং আরও অনেক খাতে ব্যবসা আছে। প্রায় ৭০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কোম্পানিতে।
বাংলাদেশের এই কিংবদন্তি মারা যান ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর। তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। জীবদ্দশায় প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজও করেছেন। তার হাত ধরে দেশের অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। তার অবদান বাংলাদেশ কোনো দিনও ভুলবেনা।
Comments