Read it in English | গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা ইসফাকুল কবির |
বর্তমান বিশ্ব নিজ দেশের প্রভাব অন্য দেশ গুলোর উপর বজায় রাখতে চাইলে সেই দেশটির বাণিজ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী হতে হবে। এবং এই দৌড়ে এগিয়ে আছে আমেরিকা, চীন, জার্মানির মতো সব দেশ। আর নিজেদের শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে আমেরিকা এবার তাদের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপকে। সম্প্রতি দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এক বক্তৃতায় কানাডা এবং মেক্সিকো কে ২৫% দিতে হবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছে। তবে এমন উদ্ভট সিদ্ধান্ত যে ট্রাম্পই করতে পারেন তা কারো অজানা ছিল না কারণ এর আগের মেয়াদে ট্রাম্প রীতিমত চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। চলুন আজ জেনে আসি এই বাণিজ্য যুদ্ধের ব্যাপারে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ
২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করে, যা দুই দেশের মাঝে এক উত্তেজনার জন্ম দেয়। বিশ্ব নেতা থেকে শুরু করে নিজ দেশের নাগরিকদের কাছেও ট্রাম্প এর সিদ্ধান্তের জন্য কথা শুনতে হয়। যার কারণ প্রতিবছর আমেরিকা চীন থেকে প্রায় ৫৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে এবং চীনে রপ্তানি করে মাত্র ১৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর তাই যদি এই অতিরিক্ত শুল্ক দিয়ে আমেরিকায় পণ্য পাঠাতে হয় চীন কে, সেক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে আমেরিকার নাগরিকরা। কারণ অতিরিক্ত শুল্ক প্রদান করলে বাজারে চীনা পণ্যের দামও থাকবে ঊর্ধ্বমুখি যা ভোক্তা ও ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করে আমেরিকার পণ্যের উপরে। দুই দেশের মাঝে যখন এই অবস্থা তখন দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মিলে বিষয়টির মীমাংসা করেন। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় ২০২০ সালে ‘ফেজ ওয়ান’ চুক্তি। যার মাধ্যমে উত্তেজনা কিছুটা কমলেও, দুই দেশের মধ্যে শুল্ক নীতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ২০২৫ সালে ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীনা পণ্যের ওপর আরও শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। তাই আবারও পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে বলে ভাবছেন অনেকেই।
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুল্ক বিরোধ
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতির কারণে কানাডাও ব্যাপক চাপের মুখে। ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে, কানাডার সব পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হবে, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি বড় আঘাত, আমরা আমাদের স্বার্থ রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেব।” কানাডার সরকার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। ট্রুডো আরও বলেন, ট্রাম্পের সাথে সরাসরি দেখা করে বিষয়টি নিয়ে কথা বললেও কোন সুফল আসেনি। তাই আগামীতে কি হবে তা নিয়ে ভাবছে সবাই।
ইউরোপ ও মেক্সিকোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি
ট্রাম্প যে একটু পাগলাটে স্বভাবের তা সবাই জানে। কিন্তু চীন রাশিয়ার মতো শত্রু দেশ ছেড়ে ট্রাম্প এখন আমেরিকার দীর্ঘ দিনের বন্ধু প্রতিবেশী কানাডা, ইউরোপ এবং মেক্সিকোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জটিল করতে চাচ্ছেন। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের ১ মাসের মধেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশের পণ্যের রপ্তানির উপর শুল্কের পরিমান বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। যার ফলে ইইউ থেকেও এসেছে পাল্টা জবাব। একইভাবে, মেক্সিকোর ওপরও নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। মেক্সিকো সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এবং আমরা কূটনৈতিকভাবে এর মোকাবিলা করবো।”
বাংলাদেশের জন্য সুফল
বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যে যখন বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে ঠিক এটাই আসল সময় বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার মার্কেট দখল করার। ট্রাম্প যখন চীন থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিবে তখন আমেরিকা চাইবে তাদের পণের ঘাটতি পুরন করতে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম এর মত দেশ গুলোর উপরে ভরসা করতে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, চীনা বিনিয়োগকারীরা নতুন বাজার খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। ইতোমধ্যে কিছু বহুজাতিক সংস্থা বাংলাদেশে উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক।
আমেরিকার প্রতি চীনের প্রতিক্রিয়া কি?
চীনা কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং এটিকে “অযৌক্তিক ও একতরফা” বলে অভিহিত করেছে। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।” পাশাপাশি, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে যে, “আমরা আমাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেব, এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।” পাল্টা প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে, চীন মার্কিন কৃষিপণ্য, গাড়ি এবং প্রযুক্তি পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য কূটনৈতিক মঞ্চে এই শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে চীন।
বর্তমানে এই বাণিজ্য যুদ্ধ শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি কানাডা, ইউরোপ, মেক্সিকোসহ অনেক দেশের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বৈশ্বিকভাবে নিজেদের অবস্থান কঠোর করতে।
Comments