মার্কেটিং ট্রেন্ডস এন্ড আইডিয়াস

সৃজনশীল মার্কেটিং কৌশল ব্যবহারে এগিয়ে যাচ্ছে কেএফসি

0
Read it in English গবেষক এবং প্রতিবেদক: তানজিল ফুয়াদ আয়েশা আক্তার

চিকেন ফ্রাই যে রেস্তোরাঁর হাত ধরে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তার নাম কেএফসি। ব্র্যান্ডটি সফলভাবে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত হয়ে বিশ্বকে দেখিয়েছে কিভাবে একটি সহজ রেসিপিকে পুঁজি করে সারা বিশ্বে এক ধরনের খাদ্য বিপ্লব তৈরি করা যায়। মাত্র ১১টি ভেষজ এবং মশলার গোপন রেসিপিতে আবদ্ধ এর আইকনিক সোনালী-ভাজা মুরগির সাথে কেএফসি বিশ্বজুড়ে ফাস্টফুড প্রেমী পরিবারের কাছে একটি প্রিয় খাবার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্ট্যাটিসটা থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে কেএফসির ব্র্যান্ড মূল্য ছিলো ৬.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার।  

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা কেএফসি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে জানবো এবং এর মার্কেটিং কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। 

শুরুর গল্প

বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ফাস্ট ফুড ব্র্যান্ড কেএফসি-এর ইতিহাস মূলত একজন মানুষের আবেগ এবং অধ্যবসায়ের গল্প বলে। কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স যিনি “কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন কিং” নামেও পরিচিত, কেনটাকি রাজ্যের কর্বিনে একটি ছোট গ্যাস স্টেশনে তার যাত্রা শুরু করেছিলে। ১১টি ভেষজ এবং মশলার গোপন রেসিপি দিয়ে বানানো তাঁর চিকেন ফ্রাই এতো বেশি জনপ্রিয় হয় যে তিনি রেস্তোরাঁ খুলেন।

কেএফসি ফাস্ট ফুড শিল্পে একটি বিশ্বস্ত ও জনপ্রিয় নাম।

বৈশ্বিক ফাস্ট ফুড বাজারে কেএফসি-র শক্ত অবস্থান। | ছবি সংগৃহীত।

বিশ্বব্যাপী তার সুস্বাদু ফ্রায়েড চিকেনের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে তার ধারণাকে ফ্র্যাঞ্চাইজ করা শুরু করে, সারা দেশে কেএফসি (কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন) নাম ছড়িয়ে দেয়। বর্তমানে কেএফসি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুড চেইন রেস্তোরাঁ।

মার্কেটিং কৌশল

কেএফসি বিখ্যাত ফাস্ট-ফুড চেইন হিসেবে বিশ্বব্যাপী নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। ফোর্বসের শীর্ষ ১০টি বিশ্বব্যাপী ফাস্ট-ফুড চেইনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা কেএফসির ফ্র্যাঞ্চাইজি বিশ্বব্যাপী ১৪৫টিরও বেশি দেশে রয়েছে।

ব্র্যান্ডটি যাত্রা শুরু করার বয়স ৭৫ বছরেরও বেশি হওয়ার পরও , তাঁর গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে কমেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে তা আরো বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেএফসি তার ৭৫০০০০+ জনবল নিয়ে সারা বিশ্বের প্রায় ১৮০০০ রেস্তোরাঁয় গ্রাহকদের কাছে তাজা সুস্বাদু ফ্রাইড চিকেন পরিবেশন করে যাচ্ছে। এখন আমরা জানবো কোন কোন মার্কেটিং কৌশল অবলম্বন করে কেএফসি আজকের অবস্থানে  পৌঁছাতে পেরেছে।

লোগো ব্র্যান্ডিং

কেএফসি-এর প্রথম লোগোতে কর্নেল স্যান্ডার্সকে একটি সাদা স্যুট এবং কালো বো টাইতে দেখা গিয়েছিলো। এই লোগো ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্র্যান্ডের একটি স্বীকৃত প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো। লাল পটভূমিটিতে ১১টি ভেষজ এবং মশলার সাথে কর্নেলের গোপন রেসিপির প্রতীক, এবং ট্যাগলাইন “ফিঙ্গার লিকিং গুড” কেএফসিকে মানুষের কাছে করে তুলেছে অতি আপন।  বর্তমান লোগোটি ঐতিহ্য এবং আধুনিকতাকে একত্রিত করে, কেএফসি ব্র্যান্ডের সারমর্মকে ধারণ করে।

কেএফসি-র লোগো ব্র্যান্ডিং এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গ্রাহকদের আকর্ষণ করছে।

কেএফসি-র লোগো ব্র্যান্ডিং তার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার অন্যতম চাবিকাঠি। | ছবি সংগৃহীত।

নিত্যনতুন পণ্য উদ্ভাবনের প্রভাব

কেএফসি শুধু ফ্রাইড চিকেনের জন্য জনপ্রিয় তা কিন্তু নয়। ভোক্তাদের পছন্দ অনুযায়ী কোম্পানিটি ক্রমাগত নতুন পণ্য এবং মেনু আইটেম চালু করেছে। স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে শুরু করে নিরামিষ ভোজীদের জন্য তারা নিত্য নতুন আইটেম উদ্ভাবন করে চলছে।

কেএফসি-এর পণ্য উদ্ভাবনের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো তাদের বিয়ন্ড ফ্রাইড চিকেনের প্রবর্তন। এটি মূলত চিকেনের পরিবর্তে বিকল্প ফ্রাইড চিকেন। নিরামিষভোজীদের কথা ভেবে এটি বানানো হয়েছে। তবে যারা স্বাস্থ্য-সচেতন, তাদের কাছেও এটি বেশ জনপ্রিয়। কেবল নতুন মেনু আইটেমের মধ্যে কেএফসি সীমাবদ্ধ নয়। বরং, কোম্পানিটি খাবারের গুণগত মান এবং স্বাদ উন্নত করতে গবেষণা এবং উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করে থাকে।

বিজ্ঞাপন কৌশল

দর্শক আকর্ষণকারী বিজ্ঞাপন তৈরির ক্ষেত্রে কেএফসি-এর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন প্রচারগুলো সৃজনশীল, আকর্ষক এবং প্রায়ই হাস্যরসের অনুভূতি জোগায়। কেএফসি-এর সবচেয়ে স্মরণীয় বিজ্ঞাপন প্রচারের একটি ছিল তাদের “ফিঙ্গার লিকিং গুড” স্লোগানের প্রবর্তন। ‘কেউ কেএফসি-এর মতো চিকেন তৈরী করে না’ এধরনের ট্যাগলাইন দর্শক আকৃষ্ট করতে ভূমিকা রাখে।

কেএফসি-এর বিজ্ঞাপনের কৌশলগুলো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতেও প্রসারিত। মিমস থেকে শুরু করে নানা আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কেএফসি ফাস্ট-ফুড শিল্পে একটি বিশ্বব্যাপী পাওয়ার হাউস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

কেএফসি তার বিজ্ঞাপন কৌশলের মাধ্যমে ব্র্যান্ড ইমেজ শক্তিশালী করছে।

কেএফসি-র বিজ্ঞাপন কৌশল ব্র্যান্ডের বাজার প্রতিযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। | ছবি সংগৃহীত।

ডিজিটাল মার্কেটিং

কেএফসি আরো বেশি গ্রাহকদের সাথে যুক্ত হতে ডিজিটাল মার্কেটিং কৌশল গ্রহণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার,ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার করে তারা নিজেদের  মার্কেটিংকে আরো শক্তিশালী করছে।

কেএফসি সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে এবং আকর্ষণ করার জন্য সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশান (এসইও) ব্যবহার করে। এসইওর ক্ষেত্রে, কেএফসি প্রাসঙ্গিক কীওয়ার্ডের জন্য তার ওয়েবসাইট অপ্টিমাইজ করার উপর ফোকাস করে। এটি নিশ্চিত করে যে কেএফসি সার্চ ইঞ্জিন ফলাফলে স্পষ্টভাবে উপস্থিত হয়।

সুলভ মূল্য এবং সহজলভ্যতা

কেএফসি-এর খাদ্য আইটেমগুলোর মূল্য বাজেটের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়।

কেএফসি-তে প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু রয়েছে। আপনার বাজেট একটু কম হলে আপনি মুরগির ছোট ডানা, একটি চিকেন লেগ পিস কিংবা বাজেট বেশি হলে পুরো পরিবারের জন্য ফ্যামিলি চিকেন বাকেট সব ধরনের অপশনই পাবেন কেএফসিতে। নানা সময় তারা বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে থাকে যাতে তাদের সকল ক্রেতারা কেএফসির খাবার উপভোগ করতে পারেন।

কেএফসি জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সহজলভ্যতা। কেএফসি-এর কর্পোরেট মালিকানাধীন রেস্তোরাঁগুলো বিমানবন্দর, ট্রেন স্টেশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় সহ অপ্রচলিত স্থানে উপস্থিত হওয়ার কারণে মানুষের কাছে বেশ তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পেরেছে। এছাড়াও কেএফসি অনলাইন এবং মোবাইল অর্ডারের সুবিধা দিয়ে থাকে যাতে গ্রাহকরা তাদের ঘরে বসে অর্ডার করতে পারেন।

কেএফসি-র খাবারের সুলভ মূল্য ও সহজলভ্যতা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তার কারণ।

সহজলভ্যতা ও সুলভ মূল্যে কেএফসি ফাস্ট ফুড প্রেমীদের কাছে জনপ্রিয়। | ছবি সংগৃহীত।

কেএফসি- এর এতো সুদীর্ঘ সময় ধরে সফলভাবে ব্যবসা করার পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তা হলো অধ্যাবসায় এবং সততা। কেএফসি কখনোই তাদের খাবারের মান কিংবা স্বাদের সাথে কম্প্রোমাইজ করে না। আর এই কারণে কেএফসি দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছে। একইসাথে তাদের মার্কেটিং কৌশল থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানদেরও শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

“তথ্যসূত্র”

একক মুদ্রা ইউরো: সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ

Previous article

কিভাবে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে বিপ্লব ঘটাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

Next article

You may also like

Comments

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *