গবেষক এবং প্রতিবেদক: শামা সুলতানা আয়েশা আক্তার
পরীক্ষার আগে রাতে কখনো জমে থাকা পড়া দেখে মনে হয়েছে , ‘ইশ! যদি বছরের শুরু থেকেই একটু করে পড়ে রাখতাম?’ অথবা কখনো অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার আগে সারারাত জেগে কাজ করার সময় মনে হয়েছে, ‘যদি কয়েকদিন আগে থেকে কাজ শুরু করতাম?’ এরকম ঘটনার সম্মুখীন আমরা কমবেশি সকলেই হয়েছি। শেষ সময়ে কাজ করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে ইশ! যদি আগে থেকে করে রাখতাম ,তবে এখন এতো কষ্ট হতো না। আবার অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও আমরা কাজ করতে পারি না, বেশিক্ষন মনোযোগ দিতে পারি না। এইধরনের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতির নাম হলো পমোডরো টেকনিক। চলুন জেনে নেওয়া যাক পমোডরো টেকনিক কি এবং কেনো এটি এতো জনপ্রিয়।
পমোডরো টেকনিক কি?
পমোডরো টেকনিক হলো একটি সময় ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি যেখানে কোনো কাজকে ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করা হয়। মূলত অধিক মনোযোগ সহকারে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কাজ করার জন্য এই পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়। পমোডরো টেকনিকে সাধারণত কাজকে ২৫ মিনিটের ব্লকে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি ব্লকের শেষে ৫ মিনিটের বিরতি রয়েছে। এই সময়ের ব্যবধান একটি পমোডরো নামে পরিচিত। এরকম চারটি পমোডরো শেষ করার পর ১৫-৩০ মিনিটের দীর্ঘ বিরতি নেওয়া হয়।
ইতিহাস
১৯৮০-এর দশকের শেষদিকে ফ্রান্সেস্কো সিরিলো নামের একজন ছাত্র সর্বপ্রথম পমোডরো টেকনিক উদ্ভাবন করেছিলেন। ইতালিয়ান ভাষায় ‘পমোডরো’ শব্দের অর্থ হলো টমেটো। মূলত ছাত্র থাকা অবস্থায় সিরিলো নিজের কাজে ঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পারতো না। সিরিলো বিশ্বাস করতেন যেকোনো অগ্রগতিই ভাল অগ্রগতি। আর তাই তিনি মাত্র দশ মিনিট ফোকাস করার জন্য নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এই চ্যালেঞ্জে পূরণ করতে গিয়ে তিনি একটি টমেটো আকৃতির রান্নাঘরের টাইমার খুঁজে পান। এই টাইমার ব্যবহার করে তিনি কাজে সফলতা পান।
পরবর্তীতে এই টমেটো আকৃতির টাইমার অনুসারে এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় পমোডরো টেকনিক। সিরিলো ‘পমোডরো টেকনিকঃ দ্যা লাইফ চেঞ্জিং টাইম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে একটি ১৬০ পৃষ্ঠার বই লিখেছিলেন। ফলে বিশ্ববাসী এই টেকনিক সম্পর্কে জানতে পারেন। বর্তমানে লেখাপড়া, চাকরিসহ যেকোনো কাজ অধিক দক্ষতা এবং মনোযোগ সহকারে করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়
কিভাবে পমোডরো কাজ করে?
পমোডরো পদ্ধতি অনুসরণ করা বেশ সহজ। এই পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য প্রয়োজন একটি টাইমার ঘড়ি। কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে খুব সহজেই এই পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব।
প্রথমত, কাজের একটি তালিকা করতে হবে। তালিকায় নির্দিষ্ট কাজের উল্লেখ থাকতে হবে। যেমন- আপনি যদি ঠিক করেন আপনি এখন পড়তে বসবেন, তাহলে কোন বইয়ের কোন অধ্যায় পড়বেন তা ঠিক করে নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এবার পমোডরো টাইমার সেট করতে হবে ২৫ মিনিটের জন্য। এই ২৫ মিনিট নিজের কাজ খুব মন দিয়ে করতে হবে। আশেপাশের কোনো চিন্তা-ভাবনা এসময় মাথায় আনা যাবে না।
তৃতীয়ত, ২৫ মিনিট শেষ হলে একটি পমোডরো সেশন সম্পন্ন হবে। একটি কাগজে বা খাতায় পমোডরো চিহ্নিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি ক্রস চিহ্ন ব্যবহার করতে পারেন। পাশাপাশি আপনি এই সময়ের মধ্যে যে কাজ সম্পন্ন করেছেন তা রেকর্ড করতে পারেন।
চতুর্থত, প্রত্যেকটা পমোডরো সেশনের পর পাঁচ মিনিট বিরতি নিতে হবে। এই পাঁচ মিনিট পড়ালেখা, কাজের চাপ কোনো কিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যাবে না। ৫ মিনিট পর আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে।
সবশেষে, এভাবে চারটি পমোডরো সেশন শেষ হলে একটি পমোডরো সেট সম্পূর্ণ হবে। এবার ১৫-২০ মিনিটের একটি লম্বা বিরতি নিতে হবে। নতুন একটি সেট শুরু করতে আগের চেকমার্কগুলো মুছে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে একদম প্রথম ধাপ থেকে।
পমোডরো সেশন ২৫ মিনিটের হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিজের কাজের চাহিদা অনুযায়ী এই সেশনের সময় কাস্টমাইজ করা যেতে পারে। তবে যারা পমোডরো কেবল শুরু করছেন ,তাদের জন্য ২৫ মিনিটের সেশন বেশ কার্যকরী।
কেনো পমোডরো টেকনিক এতো জনপ্রিয়?
বিশ্বব্যাপী পমোডরো টেকনিক বেশ জনপ্রিয়। পমোডরো টেকনিকে আমরা বড় কাজগুলোকে ছোটো ছোটো অংশে ভাগ করি। এতে কাজে একঘেয়েমিতা আসে না। এছাড়াও বেশ কিছু কারণে পমোডরো টেকনিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যেমন-
সহজেই অনুসরণযোগ্যঃ পমোডরো টেকনিক জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করা বেশ স হজ। মাত্র ২৫ মিনিট করে কাজে মন দেওয়া আমাদের কাছে বেশ সহজ মনে হয়। সাধারণত দেখা যায়, আমরা সকলে একসাথে অনেক কাজ করতে চাই। কিন্তু এতে হিতের বিপরীত হয়। কাজ তো শেষ হয় না উপরন্তু সময় নষ্ট হয়। কিন্তু এই পমোডরো পদ্ধতি অনুসরণ করে অল্প সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা যায়।
মনোযোগ ধরে রাখতে অধিক কার্যকরীঃ সাধারণত কোনো কাজ করতে গেলে আমরা সকলেই কমবেশি অমনোযোগী হয়ে যাই। বেশিক্ষণ একটি কাজে মনোযোগ ধরে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য। পমোডরো টেকনিকে যেহেতু সেশন ভাগ করা থাকে এবং প্রতি সেশন শেষে বিরতির ব্যবস্থা থাকে। তাই এই পদ্ধতিতে কাজে মনোযোগ দেওয়া তুলনামূলক সহজ হয়ে থাকে।
দক্ষতা বৃদ্ধিঃ পমোডরো টেকনিক সাধারণত নিখুঁততার পরিবর্তে ধারাবাহিকতার উপর ফোকাস করে। প্রতিটি পমোডরো সেশন আপনাকে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। অমনোযোগীভাব কাটিয়ে নিজের কাজে আরো বেশি ফোকাস করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পমোডরোর মধ্যে একটি বড় কাজ শেষ করার লক্ষ্য সেট করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে কাজ করার দক্ষতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
পমোডরো টেকনিক ব্যবহার করে যেকোনো কাজ খুব সহজেই করা সম্ভব হয়। শুধু পড়াশোনা নয়; রিসার্চ ,চাকুরিসহ যেকোন কাজে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ডেডলাইনের মধ্যে সহজেই কাজ শেষ করা যাবে।
Comments